চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি নামে একটি সংস্কৃতির স্রষ্টারা লোহার ব্যবহার শিখেছিল। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ৩০০ জায়গায় চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের সর্বস্তরে লোহার জিনিসের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়
ধরনের পাত্রগুলি মসৃণ ও হালকা ছিল। এই মুৎপাত্রগুলির রং ছাই থেকে গাঢ় ধূসর।পাঞ্জাবে রূপা, রাজস্থানে লৌহ, যোধপুর ও সরদারগড়, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে কালুয়া, বটেশ্বর, হস্তিনাপুর, মথুরা প্রভৃতি অঞ্চলে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র পাওয়া বর্শা ফলক, তীর ফলক, ঝুড়ি, স্কেতি। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির মানুষ। লোহার ব্যবহার জানত। কিন্তু এই ধাতুর ব্যবহার তাদের মধ্যে ব্যাপক ছিল না। তার লেমাও ব্যবহার করত, তবে কম। এই সংস্কৃতির সময়কাল ছিল ৮০০ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের ভিন্ন ভিন্ন মত: এই চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির ষষ্ঠ কারা, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
(১) বি বি লাল: বিবি লাল মনে করেন আর্যরা বিশেষ করে পাণ্ডবরাই এ সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। নিজের মতের সমর্থনে তিনি বলেছেন যে মহাভারতে। যে সমস্ত প্রধান প্রধান শহরের উল্লেখ আছে, প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে সেই সমস্ত শহরগুলি থেকেই চিত্রিত ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্র আবিষ্কার হয়েছে।
(২) দামোদর ধর্মানন্দ কশাম্বি: দামোদর ধর্মানন্দ কশাম্বি, বি বি লালের মতকে সমর্থন করে বলেছেন কুর-পুরুরাই চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন।
(৩) ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার: ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার বলেছেন যে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির অঞ্চলগুলি খুব সম্ভবত আর্যসভ্যতারই অংশ। রোমিলা থাপার মনে করেন বৈদিক সাহিত্যে প্রতিফলিত আর্যদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সংস্কৃতির হুবহু মিল আছে।
মূল্যায়ন: অবশ্য চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির মানুষদের সঙ্গে আর্য তথা কুরু-পুরুদের সনাক্ত করার বিষয়টি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখনো তর্ক বিতর্ক চলছে।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় চৈনিক সাহিত্যের গুরুত্ব আলোচনা করো।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের ব্যাপারে গ্রিকদের মতো চীনের লেখকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন। খ্রিস্ট্রিয় প্রথম শতাব্দীতে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হলে বহু চৈনিক পরিব্রাজক ভারত পরিভ্রমণে এসেছিলেন। এরা ভারতে এসেছিলেন প্রধানত বুদ্ধের পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত অঞ্চলগুলি দেখার উদ্দেশ্যে। তাছাড়া বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন অধ্যয়ন করা এবং বৌদ্ধ পুথি নকল করে চীনে নিয়ে যাওয়ার আগাল্লায়। এদের মধ্যে অনেকে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। যেমন-ফা-হিয়েন, ইৎ-সিং, হিউয়েন সাঙ, লুই চাও প্রমুখ।
(১) ফা-হিয়েন: ফা-হিয়েন তার 'ফা-কুয়ো' গ্রন্থে চল্লিশটি অধ্যায়ে বৌদ্ধ গুলির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। ভারতে গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত প্রায় রাজ্যগুলির সব স্থানই তিনি পরিদর্শন করেন। তবে বৌদ্ধধর্মের বাইরে তার বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না। তা সত্ত্বেও তার রচনায় তৎকালীন ভারতের শাসনতান্ত্রিক ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
(২) ইৎ-সিং: ইৎ-সিং এর রচনায় শ্রীগুপ্ত সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর রচনা থেকে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত নানা তথ্যও জানা যায়। তাছাড়া শাস্ত্র এবং সাহিত্যের বহু তথ্য পাওয়া যায়। তবে রাজনৈতিক কোনো ঘটনা তার গ্রন্থে স্থান পায়নি।
(৩) হিউয়েন সাঙ সমস্ত চৈনিক পরিব্রাজকদের মধ্যে হিউয়েন সাঙ-এর সি-য়ু-কি' রচনা সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। কারণ তিনি ভারতে দীর্ঘদিন ছিলেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন মহাবিহারে বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন এবং উত্তরভারতের থানেশ্বর পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন। তাই খ্রিস্ট্রিয় সপ্তম শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস রচনায় তিনি অপরিহার্য। হিউয়েন সাঙ-এর রচনা 'সি-যু-কি' ঐতিহাসিক তথ্যের দিক থেকে ফা-হিয়েনের রচনার থেকেও সমৃদ্ধতর। তবে তার রচনা অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট। বিশেষত হর্ষবর্ধন সম্পর্কে আলোচনার সময় এই পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়। হিউয়েন সাঙের বর্ণনায় সেই স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এইসব বিষয়ে একটি সামগ্রিক চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।
(৪) লুই চাও: খ্রিস্ট্রিয় অষ্টম শতাব্দীর অপর একজন চৈনিক পরিব্রাজক হলেন লুই চাও। তাঁর রচনা থেকে কনৌজের যশোবর্মন এবং কাশ্মীরের মুক্তাপীড় সম্বন্ধে জানা যায়।
মূল্যায়ন: পরিশেষে একথা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য তা হল এইসব বিদেশি বিবরণী থেকে ইতিহাস রচনা করতে গেলে প্রথম থেকেই নিরপেক্ষতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে বাঁচতে হলে এই পন্থা অবলম্বন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
ভারতবর্ষ নামকরণ সম্পর্কে আলোচনা করো।
প্রাচীন সাহিত্য রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণে ভারতকে দেবভূমি পুণ্যভূমি ইত্যাদি নানাভাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভারতবর্ষ নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিয় পণ্ডিত, ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে মত প্রকাশ করেছেন।
(১) প্রাচীন হিন্দু বিশ্ব তত্ত্ববিদগণের মতামত: প্রাচীন হিন্দু বিশ্বতত্ত্ববিদগ ভারতবর্ষ নামকরণ সম্পর্কে একটি নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। তারা বলেছেন সমগ্র। পৃথিবী সাতটি মহাদ্বীপে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে জম্মু দ্বীপ ছিল প্রধান। এই জহু দ্বীপ আবার নয়টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ছিল। যার মধ্যে অন্যতম হল ভারতবর্ষ।। অশোকের শিলালিপি, মহাভারত, পুরাণ, বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থ থেকে জম্মু দ্বীপের। উল্লেখ পাওয়া যায়।
(২) ধর্মগ্রন্থ: বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, যে দেশ সমুদ্রের উত্তরে ও হিমালয়ের দক্ষিণে তার নাম ভারতবর্ষ। এখানে যারা বাস করেন তারা ভারতীয় নামে পরিচিত। পুরাণ গ্রন্থ অনুসারে প্রাচীনকালে এদেশে 'ভারত' নামে জৈনিক শাসক ছিলেন এবং তার নাম অনুসারে এদেশের নামকরণ করা হয় ভারতবর্ষ। আবার মহাভারতের ভীষ্মপর্বে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরতের নাম থেকে আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়েছে বলে লেখা আছে।
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপা ভারতবর্ষের নামকরণ নিয়ে এইসব ধর্মগ্রন্থের উপর গুরুত্ব দিতে চান। কিন্তু ঋকবেদে উল্লেখিত রাজা সুদানের ভারত গোষ্ঠীর নাম থেকে ভারতবর্ষ নামের উৎপত্তি সংক্রান্ত অভিমতকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামচরণ শর্মা বলেছেন, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন-যদু, অনু, পাঞ্চাল, সৃঞ্জয়, ভারত ইত্যাদির মধ্যে ভরত নামক উপজাতি গোষ্ঠীর থেকেই ভারতবর্ষ নামের উৎপত্তি। পরে গ্রিকরা একে ইন্ডাস, মুসলিমরা হিন্দুস্থান এবং ব্রিটিশরা ইন্ডিয়া নামে অভিহিত করেছেন। এইভাবে ভারতবর্ষ নামের উৎপত্তি ঘটেছে।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতবর্ষ নামের উৎপত্তিকে কেন্দ্র করে এখনও পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে ভারতবর্ষ বলতে বর্তমানকালের খণ্ডিত ভারত নয়, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশ সহ অবিভক্ত ভূখণ্ডের নাম হল ভারতবর্ষ। পৃথিবীর প্রাচীনতম দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষ হল অন্যতম।
হরপ্পা সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।
ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম হল সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা। এরপর ভারতে আর্যসভ্যতার বা বৈদিক সভ্যতার উদ্ভব হয়। নিম্নে আর্যসভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হল-
(১) বিস্তারগত ক্ষেত্রে পার্থক্য হরপ্পা সভতা মূলত ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে তার প্রভাব গাঙ্গেয় সমভূমি ও দক্ষিণে কিছুটা বিস্তার লাভ করে। অন্যদিকে আর্যাবর্তকে কেন্দ্র করে আর্য তথা বৈদিক সভ্যতার বিস্তার ঘটে সারা ভারত জুড়ে।
(২) প্রকৃতিগত ক্ষেত্রে পার্থক্য: হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক কিন্তু আর্যসভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। আর্যদের ঘড়বাড়ি ছিল বাঁশ ও খড়ের তৈরি। অন্যদিকে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা পোড়া ইটের তৈরি বহুতল গৃহে বসবাস করত। হরপ্পার প্রশস্ত রাজপথ, উন্নত পয়ঃপ্রণালী ও স্নানাগার সমৃদ্ধ নগরজীবনের সাক্ষ্য বহন করে। অন্যদিকে আর্যসভ্যতা কৃষিকাজ, প্রশাসন, ব্যবসা বাণিজ্য, উৎপাদন-সর্বক্ষেত্রে গ্রামীণ জীবনের পরিচয় বহন করে।
(৩) লৌহের ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্থক্য হরপ্পা সভ্যতা ছিল তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। এই যুগে লোহার ব্যবহার শুরু হয়নি। অন্যদিকে বৈদিক সভ্যতা ছিল লৌহযুগের সভ্যতা। আর্যরা কৃষিকাজ, রাজনীতি তথা যুদ্ধ বিগ্রহে লোহার ব্যাপক প্রচলন ঘটিয়েছিল।'
(৪) ঘোড়া ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য বৈদিক আর্যদের কাছে ঘোড়া ছিল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। ঘোড়ার ব্যবহারে সুদক্ষ হওয়ায় আর্যদের যাযাবর ও ভাসমান জীবন গতিময় ছিল। অন্যদিকে হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার ব্যবহারের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
(৫) লিখন প্রণালীর ক্ষেত্রে পার্থক্য হরপ্পা সভ্যতার মানুষের মধ্যে লিখন প্রণালীর বহুল প্রচলন ছিল। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত অসংখ্য সিলমোহরে উৎকীর্ণ লিপি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে আর্যদের মধ্যে লিখন প্রণালীর চল ছিল না।
(৬) মৃৎপাত্র ক্ষেত্রে পার্থক্য: সিন্ধু সভ্যতার খননের ফলে যে মাটির পাত্রগুলি পাওয়া গেছে সেগুলির রঙ কালো ও লাল। কিন্তু আর্যসভ্যতা যেখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল সেই কুরু, পাঞ্চাল প্রদেশের মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ এক এগুলিতে উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির কোনো ব্যাপার ছিল না। অর্থাৎ এগুলি ছিল একেবারে সাধারণ প্রকৃতির।
(৭) ধর্মগত ক্ষেত্রে পার্থক্য: সিন্ধু সভ্যতার মানুষ গাছপালা, জীবজন্তু সহ শিব ও মাতৃকোষের আরাধনা করত। এছাড়াও হরপ্পাবাসী লিঙ্গ উপাসনা করত। বিশ্ব বৈদিক আর্যদের আমলে মাতৃকোষ ও লিঙ্গপুজার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ধর্মীয় ক্ষেত্রে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ মাতৃশক্তি এবং বৈদিক আর্যরা পুরুষশক্তির উপর আস্থাশীল ছিল।
(৮) মৃতদেহ সৎকার-গত ক্ষেত্রে পার্থক্য: আর্যরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করত। কিন্তু হরপ্পা সভ্যতার মানুষ মৃত ব্যক্তিকে সমাধি দিত।
মূল্যায়ন: আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক সভ্যতা পূর্ববর্তী হলেও বৈদিক সভ্যতার তুলনায় হরপ্পা সভ্যতা যে অনেক উন্নত ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। উভয় সভ্যতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান থাকলেও ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে উভয় সংস্কৃতির অবদান ছিল যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ