আলেকজান্ডার ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপের পুত্র। ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিলিপের মৃত্যু হলে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি সিংহাসন বসেন। সিংহাসনে বসে তিনি বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ভারত আক্রমণ করেন। তার ভারত অভিযানের কাহিনী অবশ্য ভারতীয় কোনো সাহিত্যিক উৎস থেকে পাওয়া যায় না। প্রধানত গ্রিক লেখকদের বিবরণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস থেকে তার আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়।
(ক) রাজা অন্তির আত্মসমর্পণ: খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সর্বপ্রথম ভারত ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন। তার সিন্ধু নদ অতিক্রম করার সংবাদে ভীত হয়ে সিন্ধু ঝিলাম নদীর মধ্যবর্তী তক্ষশিলার রাজা অস্তি নিজেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে গ্রিক বীরের কাছে বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করেন এবং প্রচুর উপহারসহ ভারতের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে সাহায্য করেন।
(খ) পুরুর বীরত্ব: তক্ষশিলা থেকে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে আলেকজান্ডার ঝিলাম নদীর তীরে এসে পৌঁছান। এখানে পুরুরাজ্যের রাজা পুরু প্রবলভাবে শত্রুকে বাধা দেন। কিন্তু তিনি পরাস্ত হয়ে বন্দী হন। এই যুদ্ধ হিদাস্পিসের যুদ্ধ নামে পরিচিত। আলেকজান্ডার পুরুর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন।
(গ) আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তন: পাঞ্জাব জয় সম্পন্ন করে আলেকজান্ডার বিপাশা নদীর তীরে উপস্থিত হন এবং মধ্যদেশ জয়ের উদ্যোগ করেন। কিন্তু গ্রিক সেনারা আরও অগ্রসর হতে অসম্মত হয়। তারা বছরের পর বছর যুদ্ধ করে রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। রণক্লান্ত সৈন্যদল স্বদেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাছাড়া মগধে নন্দ রাজাদের বিশাল সামরিক শক্তির কথাও তারা সম্ভবত শুনে থাকবেন কাজেই আলেকজান্ডারকে বিপাশার পশ্চিম তীর ছেড়ে ফিরে যেতে হয়।
(ঘ) ফেরার পথে যুদ্ধ ও মৃত্যু: আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তন খুব সহজ হয়নি।পথে শিবি, ক্ষুদ্রক, মালব প্রভৃতি রাজ্যের ক্ষত্রিয় জাতির কাছে তাকে প্রবল বাধার 'সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি মালবদের দুর্গ অধিকার করতে গিয়ে আলেকজান্ডার নিজেই গুরুতর আহত হন। অবশেষে সিন্ধনদের মোহনায় উপস্থিত হলে একদল সেনা নৌ সেনাপতি নিয়ারকুসের অধীনে জলপথে ম্যাসিডন যাত্রা করে। অপর দলটি সম্রাটের সঙ্গে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলাফল বা প্রভাব: আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফলাফল তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এর পরোক্ষ ফলাফদ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
(ক) পাশ্চাত্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক: ভারত আক্রমণের ফলে ভারতে সঙ্গে পাশ্চত্যের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে গ্রিক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল এবং গ্রিক ও ভারতীয়দের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতি বিষয়ে দু'দেশের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান ঘটতে থাকে। গ্রিক ভাস্কর্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় ভাস্করে গান্ধার ভাস্কর্য রীতির উদ্ভব হয়। তাছাড়া মুদ্রা ও প্রতিমা নির্মাণে গ্রিক প্রভাব দেখা যায়।
(খ) পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগ: আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে তিনটি স্থলপথ ও একটি জলপথ উন্মুক্ত হওয়ায় পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে আলেকজান্দ্রিয়া ও এথেরে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের গমনাগমন বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যেরও সম্প্রসারণ ঘটে।
(গ) সামাজিক সম্পর্ক: আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের প্রভাবে ভার ও গ্রিকের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতির আদান প্রদান বাড়ে। গ্রিক সেনাপতি সেলুকাসে কন্যাকে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বিবাহ করেন। গ্রিক রীতির অনুকরণে ভারতীয় নাটরে যবনিকার (পর্দা) ব্যবহার শুরু হয়। ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথেষ্ট গ্রিক প্রভাব পড়ে।
(ঘ) রাষ্ট্রীয় ঐক্য: আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ পরোক্ষে মৌর্য সাম্রাজ বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। এই আক্রমণের ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভি রাজ্যের উপজাতি সংগঠনের সামরিক শক্তি বিনষ্ট হওয়ায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পথে ঐ সকল অঞ্চল জয় করে ভারতে একচ্ছত্র সাম্রাজ্য গঠন এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্য সাধন সম্ভব হয়েছিল।
(ঙ) গ্রিক লেখকদের ভারত বিবরণ: আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরোক্ষ ফল হল গ্রিক লেখকদের ভারত সম্পর্কিত বিবরণী। নিয়ার্কাস, মেগাস্থিনিস প্রমুখের তথ্যবহুল বিবরণ থেকে ভারত ইতিহাসের অনেক ঘটনা সঠিক তারিখসহ জানা যায়। তাছাড়া অ্যারিয়ান, স্যাবো, ডাইমেকাস প্রভৃতি গ্রিক লেখক ও পর্যটকদের রচনা আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান ৬৭উপাদান।
মূল্যায়ন: আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কলাফল ছিল না। তবে ভারতের গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, শিল্পকলা, অথনীতি, ধর্মনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে গ্রিক প্রভাব রয়েছে তার সবগুলিই ছিল আলেকজান্ডারের ভাবত আক্রমণের পরোক্ষ ফল।সঙ্গম যুগে সাহিত্য সম্পর্কে লেখো।
তামিল সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট যুগ 'সঙ্গম যুগ' নামে খ্যাত। এই যুগ নিয়ে -তামিলভাষী মানুষ আজও গর্বিত। তামিলভাষীদের ধারণা সঙ্গমযুগ তামিল সাহিত্য ও ■ সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। ঐতিহাসিকদের মতে সঙ্গম যুগের পরিধি ছিল এক হাজার বছর, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ। ইরইয়নার রচিত আহপ্পোরুল গ্রন্থের টাকায় নক্কীবর যা লিখেছেন তা থেকে সঙ্গম যুগের পরিচয় পাওয়া যায়।
সঙ্গম সাহিত্য: কৃষ্ণ এবং তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ ভূভাগস্থিত প্রাচীন তামিল প্রদেশে সঙ্গম সাহিত্য রচিত হয়। এই সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন পান্ড্য এবং চোল রাজগণ। সঙ্গম সাহিত্য তামিলভাষায় রচিত প্রাচীনতম নিদর্শন। এই সাহিত্যের রচনাকাল একটি বিতর্কিত বিষয়। রচনাকাল নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও এর সংকলনকাল মোটামুটি জানা গেছে। ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সঙ্গম সাহিত্যগুলি সংকলিত হয়েছিল। মোট কয়টি সঙ্গম অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলা কঠিন। অষ্টম খ্রিস্টাব্দের একটি তামিল গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিনটি সঙ্গম ৯,৯০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এতে যোগদান করেছিলেন ৮,৫৯৮ জন কবি।
সঙ্গম: সঙ্গম সাহিত্য হল তামিল কবিদের সংঘ, মণ্ডল, পরিষদ অথবা সম্মেলন রচিত সাহিত্য। মোট তিনটি সঙ্গম অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
(১) প্রথম সঙ্গম: পান্ড্য রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানী মাদুরাতে প্রথম সঙ্গম আয়োজিত হয়। এই সমাবেশে নাকি দেবগণ এবং ঋষিগণ যোগদান করেছিলেন। এই সমাবেশের সভাপতি ছিলেন অগস্ত্য ঋষি। এই সঙ্গমে ৫৪৯জন বিদ্বান অংশগ্রহণ করেন। ১৮জন পান্ড্য রাজা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। প্রথম সঙ্গম যেখানে বসেছিল সেই প্রাচীন মাদুরা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
(২) দ্বিতীয় সঙ্গম: দ্বিতীয় সঙ্গম আয়োজিত হয় নতুন নগর কপাটপুরমে। কপাটপুরম বর্তমানে নিমজ্জিত নগর। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন প্রথমে অগস্ত্য, পরে তার শিষ্য। এই সম্মেলনে তামিলভাষায় ৪৯জন বিদ্বান যোগদান করেন। এই সঙ্গমে ৩৭০০ জন কবির রচনা প্রকাশের অনুমতি লাভ করে। ৩৭০০ বৎসর এই সমাবেশ স্থায়ী হয়। ৫১জন পান্ড্যবংশীয় রাজা এই সঙ্গমের পৃষ্ঠপোষ ছিলেন। দ্বিতীয় সঙ্গমে প্রামাণ্য বলে ঘোষিত গ্রন্থগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। পাওয় গেছে একমাত্র 'তোলকান্নিয়ম' নামক ব্যাকরণ গ্রন্থ। বাসামের মতে 'তোলকারিয় গ্রন্থটি তৃতীয় সঙ্গম থেকে উদ্ভূত।
(৩) তৃতীয় সঙ্গম: দ্বিতীয় সঙ্গম সমাপ্ত হওয়ার পরে সমুদ্র কপাট পুরম প্রচ করে। সুতরাং তৃতীয় সঙ্গম আবার মাদুরা নগরেই অনুষ্ঠিত হয়। এই সঙ্গমে কার্যকাল ছিল প্রায় ১৮৫০ বৎসর। এই সঙ্গমে ৪৯জন বিদ্বান অংশগ্রহণ করেন এই সম্মেলনে ৪৪৯জন কবি তাদের রচিত গ্রন্থ প্রকাশের অনুমতি পেয়েছিলেন প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গম সম্পর্কে সংশয় থাকলেও তৃতীয় সঙ্গম ছিল নিঃসন্দে বাস্তব। অবশ্য এর বিবরণ অতিরঞ্জিত। তৃতীয় সঙ্গমে যে ৪৯জন বিশেষজ্ঞ উপস্থি ছিলেন বলা হয়েছে তাদের নামের তালিকা তিরুবন্ধুবরের 'কুরল' গ্রন্থের শো উল্লিখিত হয়েছে। এই সম্মেলনেও কয়েকটি গ্রন্থ প্রামাণ্য বলে ঘোষিত হয়। তামে বেশিরভাগ লুপ্ত হলেও কয়েকটি এখনও টিকে আছে। তৃতীয় সঙ্গমে উপস্থাপি 'অষ্টকাব্যসংগ্রহ' তামিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই গ্রন্থ অবশ্য তামিলভূমি বাইরে প্রায় অপরিচিত। এর ভাষা এমনই প্রাচীন ও অপ্রচলিত যে বিশেষ অধ্যায় ব্যতীত শিক্ষিত তামিলভাষীর পক্ষেও পাঠ করা প্রায় অসম্ভব।
মূল্যায়ন: দক্ষিণ ভারতের সঙ্গমের মতো বিশাল কবি-সমাবেশ উত্তরভারছে প্রাচীনকালে পরিলক্ষিত হয় না। তামিলভূমির কবিগণ সম্ভবত সারা দেশে ঘুরে ঘুড়ে সামন্তপ্রভু ও সাধারণ মানুষ দুয়ের কাছেই সম্মান ও সমাদর লাভ করতেন এক কিছুদিন পরপর মাদুরা নগরে সমবেত হতেন। কবি সম্মেলনের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠি হত সংগীত উৎসব ও কাব্য উৎসব।