আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ (আনুমানিক ৬৫০ খ্রি. মতান্তরে ৯৫০ খ্রি.-১২০০ খ্রি.)
মধ্যযুগ (১২০১ খ্রি.-১৮০০ খ্রি.)
আধুনিক যুগ (১৮০১ খ্রি. বর্তমান কাল)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো নির্দিষ্ট সালতারিখ অনুযায়ী সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাজন করা সম্ভব নয়। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সালতারিখের হিসেব অগ্রাহ্য করে না। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।
আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ
বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের পূর্বে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অবহট্ঠ ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়ের সূচনা হয়। [৩] ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি বিজয়ের বহু পূর্বেই বাঙালিরা একটি বিশেষ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উন্মেষ ঘটে বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম্, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত নামক দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্ট ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সকল গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম্ স্কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।
বিষ্ণুর সম্মুখে প্রণত জয়দেব, বাংলার বৈষ্ণব
সাহিতো তাঁর গীতগোবিন্দম্রকাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। এমনকি ববীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে রচিত কাব্যও জয়দেবের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর।
বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।
মধ্যযুগ
ত্রয়োদশ শতাব্দী: বাংলা সাহিত্যের "অন্ধকার যুগ"
বাংলা সাহিত্যের ১২০০-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে "অন্ধকার যুগ” বা “বন্ধ্যা যুগ” বলে কেউ কেউ মনে করেন। লিখেছেন- "১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত কোন সাহিত্য কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়না বলে এ-সময়টাকে বলা হয় 'অন্ধকার যুগ'। পণ্ডিতেরা এ-সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি। এ- সময়টির দিকে তাকালে তাই চোখে কোন আলো আসেনা, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।" কিন্তু, ওয়াকিল আহমদ তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত' -এ লিখেছেন- "বাংলা সাতিহ্যের কথিত 'অন্ধকার যুগ' মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।”
এসময়ের সাহিত্য নিদর্শন:
১. গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ 'প্রাকৃত পৈঙ্গল'
২. রামাই পণ্ডিত রচিত 'শূন্যপুরাণ' (গদ্যপদ্য মিশ্রিত)
৩. হলায়ুধ মিশ্র রচিত 'সেক শুভোদয়া' (গদ্যপদ্য মিশ্রিত)
৪. ডাক ও খনার বচন প্রাক চৈতন্য বৈষ্ণব সাহিত্য
প্রাক চৈতন্য বা প্রারম্ভিক বৈষ্ণব সাহিত্য বলতে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের প্রতিষ্ঠাতা চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়কালের পূর্বে রচিত সাহিত্যকে বুঝায়। এর মধ্যে রয়েছে: বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন; এটি মূলত গীতধর্মী কবিতার সংকলন যা বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলি নামে পরিচিত; শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, এটি হল ভগবৎ পুরাণের আংশিক অনুবাদ যা মালাধর বসু কর্তৃক রচিত এবং কৃত্তিবাসের রামায়ণ যা কৃত্তিবাস ওঝা দ্বারা রচিত হয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন
বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্যতভল্লব আধুনিক দিনের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাকিলা গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘর থেকে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের ছিন্নপত্রের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষার্ধে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বড়ু চণ্ডীদাস কর্তৃক লিখিত হয়েছিল। চর্যাপদের পরে এটি বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় প্রাচীনতম কাজ বলে বিবেচিত হয়।
বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব গান
পঞ্চদশ শতকে বৈষ্ণব গদ্য কবিতার বা বাংলা পদাবলির উত্থান হয়েছিল। মিথিলার মহান কবি বিদ্যাপতির কবিতা যদিও তা বাংলা ভাষায় লিখিত হয়নি তথাপি এটি বাংলা সাহিত্যকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে এটি তাকে মধ্য-বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তোলে। চতুর্দশ শতাব্দীতে তিনি ভারতের বিহারের আধুনিক ভাববঙ্গ জেলায় সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বৈষ্ণব গান বাংলার জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। চণ্ডীদাস ছিলেন প্রথম প্রধান বাঙালি কবি যিনি বৈষ্ণব গান লিখেছিলেন, যিনি আধুনিক দিনের বীরভূম জেলার (বা অন্য মতামত অনুযায়ী, বাঁকুড়া জেলার) পঞ্চম শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন। চণ্ডীদাস তাঁর মানবতার ঘোষণার জন্য সুপরিচিত- "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই.
মালাধর বসু এবং কৃত্তিবাস ওঝা
দুটি বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ ভাগবত পুরাণ এবং রামায়ণ মধ্য বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় (শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, লর্ড কৃষ্ণের বিজয়), যা মূলত ভাগবত পুরাণের দশম এবং একাদশ পাঠের অনুবাদ, এটি একটি পূর্বতন বাংলা কাহিনী যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা যায়। পঞ্চদশ শতকে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত পঞ্চিমবঙ্গে মালাধর বসু সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেছিলেন। ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে রচিত শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ছিল কৃষ্ণের কিংবদন্তীর প্রাচীনতম বাংলা বর্ণনামূলক কবিতা।
রামায়ণ শ্রী রাম পাঁচালী শিরোনামের অধীনে যা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামেও পরিচিত কৃত্তিবাস ওঝা দ্বারা অনুবাদিত হয়েছিল, যিনি আজাদ নদীয়া জেলার অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন। তিনিও মালাধর বসুর মতো পঞ্চদশ শতকেরও বেশি সময় ধরে অগ্রসর হয়েছিলেন।
চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব সাহিত্য
চৈতন্যোত্তর বা বৈষ্ণব পরবর্তী সাহিত্য চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় পরবর্তীকালের সাহিত্যের সূচনা করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে, চৈতন্যের জীবনের উপর ভিত্তি করে এবং পরে বৈষ্ণব পদাবলী গৌড়ীয় বৈষ্ণব পণ্ডিত বা কবিদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব পরবর্তী সাহিত্যের প্রধান পদকর্তা ছিলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস ঠাকুর, জয়ানন্দ, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস প্রমুখ।
আধুনিক যুগ
মূলত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও, মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন। কালের দিক থেকে আধুনিক যুগকে কয়েক টি ধাপে ভাগ করা যায়- ১৭৬০-১৭৯৯খ্রিঃ (আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব) ১৮০০-১৮৫৮ খ্রিঃ (আধুনিক যুগের দ্বিতীয় পর্ব) ১৮৫৯-১৯০০খ্রিঃ (আধুনিক যুগের তৃতীয় পর্ব) ১৯০১-১৯৪৭খ্রিঃ (আধুনিক যুগের চতুর্থ পর্ব) ১৯৪৮-২০০০ খ্রিঃ (আধুনিক যুগের পঞ্চম পর্ব) ২০০১খ্রিঃ- বর্তমানকাল (আধুনিক যুগের ষষ্ঠ পর্ব)
- প্রাক-রবীন্দ্র যুগ
- রবীন্দ্র যুগ
- রবীন্দ্রোত্তর যুগ
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য
- পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য
- পূর্ব পাকিস্তান-বাংলাদেশের সাহিত্য
- সাহিত্যধারা
- চর্যাপদ
- চর্যাপদ পুঁথির একটি পৃষ্ঠা
চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ়ার্থ সাংকেতিক রূপবন্ধে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলি রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীতের শাখাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই। এই বিবেচনায় এটি ধর্মগ্রন্থ স্থানীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলিতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ আজও চিত্তাকর্ষক। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন। চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।