ইতিহাস রচনায় সাহিত্যগত উপাদান।


প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি হল-প্রত্নতাত্তিক উপাদান ও সাহিত্যিক উপাদান। সাহিত্যিক উপাদানগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করাধিক যথা-(ক) দেশীয় সাহিত্য এবং (২) বিদেশি সাহিত্য।

দেশীয় সাহিত্য :- দেশীয় সাহিত্যগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।

(১) ধর্মীয় সাহিত্য: আর্যদের আগমনের পর থেকে আলেকজান্ডারের আগমন পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের প্রধান উপকরণ বা উপাদান হল ধর্মীয় সাহিত্য।

(ক) বৈদিক সাহিত্য ধর্মভিত্তিক সাহিত্যের মধ্যে প্রধান হল বৈদিক সাহিত্য। বৈদিক যুগের সাহিত্যগুলি হল চতুর্বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। এই সাহিত্যগুলি থেকে বৈদিক যুগে আর্যদের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনীতি সম্পর্কে জানা যায়।

 (খ) জীবনী সাহিত্য: রাজাদের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য বা গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। যেমন, বানভট্টের 'হর্ষচরিত', বিলহনের 'বিক্রমাদিত্য চরিত্র', সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

(গ) বিবিধ সাহিত্য: বিবিধ সাহিত্য বলতে বোঝায় নাটক, কাব্য ইত্যাদি। মহাকবি কালিদাস রচিত রঘুবংশ, ধোয়ী রচিত পবনদূত, কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অপ্রত্যাশিতভাবে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

(ঘ) আঞ্চলিক সাহিত্য বা ইতিহাস প্রাচীন ভারতের কেমাত্র প্রকৃত ইতিহাস গ্রন্থ হল কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী'। রাজতরঙ্গিনী থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়। এছাড়া সোমেশ্বর রচিত রাসমালা, তামিল সঙ্গম সাহিত্য প্রভৃতি আঞ্চলিক সাহিত্যগুলি থেকে প্রাচীন ভারতের বহু তথ্য জানা যায়।

বিদেশি সাহিত্য: গ্রিক, রোমান, চৈনিক, তিব্বতীয়, আরবীয় প্রভৃতি

বৈদেশিক লেখক ও পর্যটকদের বিবরণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রিনির 'প্রাকৃতিক ইতিহাস', মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা', ফা-হিয়েনের 'ফো-কুয়ো-কিং', হিউয়েন সাজে 'সি-ইউ-কি', অল বিরুনীর 'তহকিক-ই-হিন্দ' প্রভৃতি। এই গ্রন্থগুলি থেকে সমসাময়িক কালের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস জানা যায়।

 মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানের তথ্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলি সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের কাহিনী কিংবদন্তী কাহিনী থেকে পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়বে।

 ইতিহাস রচনায় লিপি।

উত্তর:- প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বলতে বোঝায় প্রাচীনকালের যে সকল নিদর্শন মাটির ওপরে বা খননকার্যের ফলে মাটির অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে- (ক) লিপি বা লেখমালা (খ) মুদ্রা এবং প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও স্থাপত্য ভাস্কর্য।

 লিপি বা লেখমালা: লিপি বা লেখমালা বলতে বোঝায় প্রস্তরখণ্ড, স্তম্ভ, গুহার দেওয়াল, তামার পাত বা অন্য কোনো কঠিন বস্তুর ওপর উৎকীর্ণ করা বক্তব্য, ভারতে প্রাপ্ত লিপিগুলির মধ্যে হরপ্পা লিপি প্রাচীনতম। তবে এই লিপিগুলি আজও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ভারতে প্রাপ্ত খ্রি. পূর্ব তৃতীয় শতকের লিপিগুলিতে প্রাকৃত ভাষা এবং খ্রি.দ্বিতীয় শতক থেকে লিপিগুলিতে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। খ্রি. নবম ও দশম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লিপির ব্যবহার শুরু হয়।

 লিপি বা লেখমালার শ্রেণিবিভাগ: লিপি বা লেখমালাকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা-(ক) দেশীয় লিপি এবং (খ) বিদেশি লিপি।

(১) দেশীয় লিপি: প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে অশোকের লেখগুলি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। অশোকের লেখগুলি থেকে অশোকের সাম্রাজ্যের সীমা, প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক, রাষ্ট্রশাসকের চরিত্র, জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি জানা যায়। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুম্ফা লেখ, শকরাজ রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখ প্রভৃতি লেখগুলি থেকে তাদের আমলের রাজনৈতিক ইতিহাস জনা যায়। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেনের 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে সমুদ্রগুপ্তের আর্যাবর্ত, দাক্ষিণাত্য অভিযানের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তির 'আইহোল শিলালিপি' থেকে জানা যায় যে সকলোত্তরাপথনাথ হর্ষবর্ধন পুলকেশীর কাছে পরাজিত হওয়ায় দাক্ষিণাত্যে আর অগ্রসর হতে পারেননি। এছাড়া হর্ষবর্ধনের 'তাম্রলিপি', শশাঙ্কের 'গঞ্জামলিপি', ধর্মপালের 'খালিমপুর তাম্রশাসন' প্রভৃতি লিপি বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে।

(২) বিদেশি লিপি: ভারতের বাইরে এশিয়া মাইনরের বোখাজ কোই নামক স্থানে প্রাপ্ত বোখাজ কোই শিলালিপি আর্যদের ভারতে আগমন সম্পর্কে আলোকপাত করে। পারস্যের বেহিস্তান পার্সেপলিস ও নাকশ-ই-রুস্তম নামক স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে ভারত ও পারস্য যোগাযোগ ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে পারসিক আধিপত্যের কথা জানা যায়।

লিপি বা লেখমালার গুরুত্ব: লিপি বা লেখমালা থেকে রাজ্য বা শাসকের নাম, শাসনকাল, বিজয় অভিযানের চরিত্র, শাসিত অঞ্চলের সীমানা, সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য জানা যায়।

ইতিহাস রচনায় মুদ্রা।

যেসব প্রামাণ্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করা যায় তাদের বলা হয় ইতিহাসের উপাদান। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে সাধারণভাবে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) সাহিত্যিক উপাদান (খ) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।

 প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান: প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বলতে বোঝায় প্রাচীনকালের যে সকল নিদর্শন মাটির ওপরে বা খনন কার্যের ফলে মাটির অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে। ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে- (ক) লিপি বা লেখমালা (খ) মুদ্রা এবং (গ) প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও স্থাপত্য ভাস্কর্য।

মুদ্রা: প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের প্রশ্নে লেখমালার পরেই মুদ্রার অবস্থান। প্রাচীন ভারতের মৌর্য, গুপ্ত, শুঙ্গ, শক, কুষাণ, সাতবাহন প্রমুখ শাসকদের আমলের বহু বিচিত্র মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় লক্ষ্মীদেবীর ছবি অঙ্কিত। গুপ্ত সম্রাটরা সকলেই নিজেদের মুদ্রায় 'পরম ভাগবত' শব্দগুচ্ছ খোদাই করাতেন। এসব দেখে মনে হয় তারা বৈষ্ণব ছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মূর্তি দেখে সম্রাটের সংগীত প্রীতির কথা জানা যায়। অশ্বমেধ যজ্ঞ করে সমুদ্রগুপ্ত তার মুদ্রায় অশ্বের মূর্তি খোদাই করেন। কণিষ্কের প্রতিমূর্তি শুধুমাত্র কুষাণ মুদ্রা থেকে জানা যায়। সাতবাহনদের মুদ্রায় জাহাজের ছবি দেখে তাদের আমলের সামুদ্রিক ও বহির্বাণিজ্যের কথা জানা যায়।

মুদ্রার গুরুত্ব: মুদ্রায় প্রাপ্তিস্থান থেকে শাসকের রাজ্যসীমা যেন জানা যায়, অন্য দেহে সেই মুদ্রার সন্ধান বহির্ভারতের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্দেশ করে মুদ্রায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধাতুর গুণগত মান দেখে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বোন যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুদ্রাই কোনো শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে একম উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। যেমন তেত্রিশজন ব্যাকট্রীয় শাসকের নাম শুধুমাত্র তাদের মুদ্রা থেকেই জানা সম্ভব। শক-কুষাণ-পার্থিয়ানদের ইতিহাস রচনা মুদ্রা ছাড়া একেবার অসম্ভব।

ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বলতে বোঝায় প্রাচীনকালের যে সকল নিদর্শন মাটির ওপরে বা খনন কার্যের ফলে মাটির অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে- (ক) লিপি বা লেখমালা (খ) মুদ্রা এবং (গ) প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও স্থাপত্য ভাস্কর্য।

(ক) লিপি: প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে অশোকের লেখগুলি সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। অশোকের লেখগুলি থেকে অশোকের সাম্রাজ্যের সীমা, প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক, রাষ্ট্রশাসনের চরিত্র, জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ, ধর্মপ্রচার প্রভৃতি জানা যায়। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুম্ফা লেখ, শকরাজ রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখ প্রভৃতি লেখগুলি থেকে আমলের রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায়। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেনের 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে সমুদ্রগুপ্তের আর্যাবর্ত, দাক্ষিণাত্য অভিযানের বিস্তৃতি বিবরণ পাওয়া যায়। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তির 'আইহোল শিলালিপি' থেকে জানা যায় যে সকলোত্তরপথনাথ হর্ষবর্ধন পুকেশীর কাছে পরাজিত হওয়ায় দাক্ষিণাত্যে আর অগ্রসর হতে পারেননি। এছাড়া হর্ষবর্ধনের 'তাম্রলিপি' শশাঙ্কের 'গঞ্জামলিপি', ধর্মপালের 'খালিমপুর তাম্রশাসন' প্রভৃতি লিপি িিভন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে। 

(খ) মুদ্রা: প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের প্রশ্নে লেখমালার পরেই মুদ্রার অবস্থান। প্রাচীন ভারতের মৌর্য, গুপ্ত, শুঙ্গ, শক, কুষাণ, সাতবাহন প্রমুখ শাসকদের আমলের বহু বিচিত্র মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় লক্ষ্মীদেবীর ছবি অঙ্কিত। গুপ্ত সম্রাটরা সকলেই নিজেদের মুদ্রায় 'পরম ভাগবত' শব্দগুচ্ছ খোদাই করাতেন। এসব দেখে মনে হয় তারা বৈষ্ণব ছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত মূর্তি দেখে সম্রাটের সংগীত প্রীতির কথা জানা যায়। অশ্বমেধ যজ্ঞ করে সমুদ্রগুপ্ত তার মুদ্রায় অশ্বের মূর্তি খোদাই করেন। কণিষ্কের প্রতিমূর্তি শুধুমাত্র কুষাণ মুদ্রা থেকে জানা যায়। সাতবাহনদের মুদ্রায় জাহাজের ছবি দেখে তাদের আমলের সামুদ্রিক ও বহির্বাণিজ্যের কথা জানা যায়।

(গ) প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও স্থাপত্য ভাস্কর্য: প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পরীতির বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের বিশ্লেষণ করে প্রাচীন নগরসভ্যতার যেসব বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, সুপ্রাচীনকালেই ভারতে উন্নত ধরনের একটি নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির সমসাময়িক। তাছাড়া তক্ষশিলা, পাটলিপুত্র, প্রাচীন সারনাথ প্রভৃতি স্থানে খননকার্যের ফলে সমৃদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। অশোকের স্তম্ভগুলি মৌর্যযুগের ভাস্কর্যের উৎকর্ষতা প্রমাণ করে। অজন্তা ও ইলোরার গুহাচিত্রগুলি প্রাচীন শিল্পকলার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মূল্যায়ন: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান প্রায় অবিকৃত অবস্থায় থাকে। তাই তা থেকে প্রাপ্ত ইতিহাস অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।