গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধধর্মের নীতিসমূহ আলোচনা

 প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ছিল অনুসন্ধানের যুগ। বৈদিক যুগের ধর্মের জটিলতা, আয়ম্বরপূর্ণ আচার অনুষ্ঠান ও পুরোহিততন্ত্রের দাবি দাওয়া মানুষের মনে এক প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এই প্রতিবাদী ধর্মীয় বাতাবরণ। থেকেই বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব ঘটে।

(১) বৌদ্ধধর্ম: খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে যেসব ধর্মপ্রচারক ধর্ম প্রচার করছিলেন তাদের মধ্যে গৌতম বুদ্ধ অন্যতম। কিংবদন্তী অনুসারে তার জন্ম ৫৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। গৌতম বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোদন প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য কপিলাবস্তুর রাজা ছিলেন। প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যে জন্ম গ্রহণ করবার ফলে গৌতম বুদ্ধের মধ্যে সমতাবাদী প্রভাব সক্রিয় ছিল। গৌতম বুদ্ধ সংসার জীবন পালন করেছিলেন। তার বিবাহিতা স্ত্রী এবং পুত্রসন্তান ছিল। সংসার জীবন যাপনকালে এক সময় গৌতম বুদ্ধ মানুষের মুক্তির সন্ধানে গৃহত্যাগ করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের গৃহতাগ বৌদ্ধ শাস্ত্রে 'মহাভিনিষ্ক্রমণ' বলা হয়।

(২) বোধি বা পরমজ্ঞান: গৃহত্যাগের পর নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গৌতমবুদ্ধ এক সময় নৈরঞ্জনা নদীর তীরে, বর্তমান বুদ্ধগয়াতে, একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে ধ্যানমগ্ন হন। ঐখানেই তিনি একদিন বোধি বা পরমজ্ঞান লাভ করেন। সেই সমা থেকে অশ্বত্থ গাছটি বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিত হয়। বোধি লাভ করার জন্য তিনি রা বা জ্ঞানী নামে পরিচিত হন।

(৩) ধর্মচক্র প্রবর্তন: বোধিলাভের পরে গৌতম বুদ্ধ বারানসীর কাছে পাঁচজন ভিক্ষুককে প্রথম তার ধর্মমত প্রচার করেন। এই ঘটনা 'ধর্মচক্র প্রবর্তন' নামে অভিহিত। গৌতম বুদ্ধের ধর্মপ্রচারের সূচনা ঐ সময় থেকেই। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তিনি আপামর জনসাধারণের মধ্যে ধর্মপ্রচার করে বহু নরনারীকে নিজ ধর্মে দীক্ষিত করেন।

(৪) আর্যসত্য: বুদ্ধদেব ছিলেন বাস্তববাদী সংস্কারক। মানবজাতি জাগতিক দুঃখকষ্ট থেকে যাতে মুক্তি পায় তার পথ নির্দেশ করাই ছিল বুদ্ধের একান্ত কামনা। তিনি মনে করতেন যে মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা পুনরায় জন্মলাভ করে। এই নবজন্মের পর তাকে গত জন্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়। কর্মফল ও তার পরিণাম দুঃখ সম্পর্কে গৌতম বুদ্ধ চারটি সত্য উপলব্ধি করেন যা 'আর্যসত্য' বা মহান সত্য নামে অভিহিত হয়। এই চারটি সত্য হল-(১) জগৎ দুঃখময় (২) দুঃখের কারণ আছে (৩) দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব এবং (৪) দুঃখ নিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ পথ কী তা জানতে হবে।

(৫) মধ্যপন্থা বা মঝঝিম পন্থা: দুঃখের কারণ নির্ধারণ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বলেছেন অতৃপ্ত বাসনাই দুঃখের মূল কারণ। এই অতৃপ্ত বাসনার জন্যই মানুষকে আবার জন্মগ্রহণ করে পার্থিব সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। কাজেই বাসনার নিবৃত্তি ঘটানোই হল পার্থিব দুঃখ দূর করার এবং মুক্তি অর্থাৎ নির্বাণ লাভের একমাত্র উপায়। তিনি মনে করতেন যে চরম ভোগবিলাস এবং চরম কৃচ্ছসাধন ও তপশ্চর্যা দুই-ই আত্মার উন্নতির পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ। তাই তিনি এই দুই চরম পন্থার মধ্যবর্তী। 'মধ্যপন্থা' বা 'মঝঝিম' পন্থা অবলম্বন করতে বলেছেন।

(৬) অষ্টাঙ্গিক মার্গ: মানুষের আসক্তি বিনাশের জন্য নির্বাণ লাভের মধ্যপন্থাহিসাবে বুদ্ধদেব আটটি উপায় নির্দেশ করেছেন। এগুলি অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে খ্যাত। এগুলি হল (১) সৎ বাক্য (২) সৎ কর্ম (৩) সৎ জীবন (৪) সৎ চেষ্টা (৫) সৎ চেতনা (৬) সৎ চিন্তা (৭) সৎ সংকল্প এবং (৮) সৎ সমাধি।

(৭) পঞ্চশীল: গৌতম বুদ্ধ তার অনুগামীদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচটি নির্দিষ্ট আচরণ বিধি মেনে চলার কথা বলেছেন। এগুলিকে পঞ্চশীল বলা হয়। যথা- (১) হিংসার আশ্রয় না নেওয়া (২) অন্যের সম্পত্তির ওপর লোভ বা দখল না করা (৩) মাদক দ্রব্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা (৪) অসত্য কথন থেকে বিরত থাকা এবং (৫) ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা।

(৮) বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ: বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর তার প্রধান শিষ্যরা রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় সম্মিলিত হয়ে বুদ্ধের উপদেশগুলি পালি ভাষায় গ্রন্থাকারে সংকলন করেন। এটি ইতিহাসে প্রথম বৌদ্ধ সংগীত বা মহাসম্মেলন নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে যে গ্রন্থ সংকলিত হয় তার নাম ত্রিপিটক। ত্রিপিটক তিনটি ভাগে বিভক্ত। যথা-১) সূত্র পিটক-এতে বুদ্ধের উপদেশ ও বাণী সংকলিত হয়েছে (২) বিনয় পিটক-এতে আছে বৌদ্ধভিক্ষু ও ভিক্ষুনীদের পালনীয় কর্তব্যের নির্দেশ এবং আচার আচরণ সম্পর্কে বিধি নিষেধ (৩) অভিধর্ম পিটক-এতে আছে বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা। এছাড়া পালি ভাষায় রচিত 'জাতক' নামের গ্রন্থে বোধিলাভের পর্বে বৃদ্ধদেবের জন্মের পাঁচশোটি কাহিনী আলোচিত হয়েছে।

(৯) জনজীবনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব: বৌদ্ধধর্ম ভারতের জনজীবনে গভীর রাতার বিস্তার করেছে। বৌদ্ধধর্ম ব্যয়ব হাতাবা। বৌদ্ধধর্ম ভারতের জাভানাতের ভেদাতের বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে প্রথম সার্থক প্রতিবাদিক যাগযজ্ঞ-বলিপ্রথা, আসামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। সাধারণ মানুয়ারেতে আকৃষ্ট হয়। সংস্কৃতের বদলে সাধারণের বোধগম্য পালি ও প্রকৃত ভাষা ব্যবহার করার ফালে বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

 মূল্যায়ন: বৌদ্ধধর্ম নিজ আদর্শ থেকে ধীরে ধীরে সরে এলে মানুষের কাছে এর আকর্ষণ কমে যায়। বৌদ্ধধর্মে ধীরে ধীরে অবক্ষয় আসে। তবে অস্বীকার করা যাবে না যে, বৌদ্ধধর্ম এদেশের জনজীবনে, অর্থনীতিতে, সাহিত্যে, শিল্পকলায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরের ধর্মনীতি আলোচনা করো।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ছিল অনুসন্ধানের যুগ। বৈদিক। যুগের ধর্মের জটিলতা, আড়ম্বরপূর্ণ আচার অনুষ্ঠান ও পুরোহিততন্ত্রের দাবি দাওয়া মানুষের মনে এক প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এই প্রতিবাদী ধর্মীয় বাতাবরণ থেকেই জৈন ধর্মের আবির্ভাব ঘটে।

(১) জৈনধর্ম: জৈনরা বিশ্বাস করে যে মোট ২৪জন তীর্থঙ্কর জৈনধর্ম প্রচার করেছিলেন। জৈন ধর্মের প্রথম প্রবর্তক হলেন ঋষভনাথ এবং ২৩তম পার্শ্বনাথ। আর সর্বশেষ বা ২৩তম তীর্থংকর হলেন মহাবীর। তীর্থংকররা সংসার দুঃখ পার হওয়ার। জন্য তীর্থ বা ঘাট নির্মাণ করেছিলেন। তাই তাদের তীর্থংকর বলা হয়। তীর্থংকররা সব।

রকমের লোভ, আকর্ষণ, ক্রোধ ও বিদ্বেষ জয় করে জয়ী বা জিন হয়েছিলেন। জিন থেকে জৈন কথার সৃষ্টি। যারা জিন-এর উপাসক তারাই জৈন। ২৩তম তীর্থংকর পার্শ্বনাথ জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠিাতা ছিলেন। মহাবীর ছিলেন জৈনধর্মের একজন শক্তিশালী। প্রচারক এবং সংস্কারক। অধ্যাপক রামশরণ শর্মা মহাবীরকেই জৈনধর্মের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। বলে বর্ণনা করেছেন।

(২) চতুর্যাম ও পঞ্চমহাব্রত: জৈন ধর্মমত অহিংসা, প্রেম, ত্যাগ এবং মোক্ষলাভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। জৈন ধর্মে পাঁচটি ব্রত। পালনের কথা আছে। যেমন- (১) অহিংসা (২) সত্যবাদিতা (৩) অচৌর্য (৪) বিবর সম্পত্তির ওপর অনাসক্তি এবং (৫) ব্রহ্মচর্য। প্রথম চারটি ব্রত পার্শ্বনাথ প্রবর্তন করেন। চারটি একত্রে 'চতুর্যাম' নামে অভিহিত। পরে মহাবীর পঞ্চম ব্রত ব্রহ্মাচর্য যুক্ত। করেছিলেন।

(৩) ত্রিরত্ন: মহাবীর ও তার অনুগামীরা কর্মফলবাদ ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। নিপ্রবার্গের মানুষ ভালো কর্ম করলে উচ্চবর্ণে উত্তরণ ঘটে। কর্মফল ও জন্মান্তরের ফলে সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন চক্রকারে মানুষের জীবনে আসে। এর থেকে চির মক্তি পেতে সৎ জ্ঞান, সৎ আচারণ ও সৎ বিশ্বাসই একমাত্র পথ। এই তিনটি নীতিকে বলে 'ত্রিরত্ব'। এই ত্রিরত্বকে বলা হয় সিদ্ধশিল। কারণ এর দ্বারা মানুষ পরম আনন্দ লাভকরতে পারে বা আত্মার মক্তি আসে। ৫৭

(৪) আত্মার শুদ্ধিকরণ: জৈন মতে জীবনের উদ্দেশ্য হল আত্মার শুদ্ধিকরণ। এই অতিকরণ জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়। দীর্ঘ সময় ধরে উপবাসের মাধ্যমে তা সম্ভব। তাছাড়া কঠোরভাবে পঞ্চমহাব্রত পালন করলে শুদ্ধিকরণ সম্ভব হবে।

(৫) অহিংসা ও অনাসক্তি: জৈনধর্মে অহিংসা ও অনাসক্তিকে চরমভাবে পালন করতে হয়। জৈনরা মনে করে সবকিছুতেই প্রাণ আছে। এমনকি বাতাসে যেসব অদৃশ্য জীবাণু ঘুরে বেড়ায় সেগুলিও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেইজন্য জৈনরা মুখে কাপড়ের টুকরো বেঁধে রাখে। আবার ইহজগতের কোনো কিছুর ওপর যাতে আসক্তি না জন্মায় সেই কারণে জৈনরা পরিধানের বস্ত্রকে পর্যন্ত বর্জন করেছিল। মহাবীর নিজে বস্ত্র পরিত্যাগ করে দিগম্বর থাকতেন। পরে একসময় অবশ্য শ্বেতবস্ত্র পরবার রীতি চালু হয়।

(৬) জৈন ধর্মগ্রন্থ: মহাবীরের মৃত্যুর প্রায় ২০০ বছর পর মগধের পাটলিপুত্র নগরে স্থূলভদ্রের উদ্যোগে প্রথম জৈন সংগীতি বা সম্মেলন আহৃত হয়। এই সময় মহাবীর প্রচারিত বিভিন্ন উপদেশগুলি বারোটি খণ্ড বা অঙ্গে সংকলিত হয়। ইহাই জৈনদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ 'দ্বাদশঅঙ্গ'। পরে জৈন ধর্মশাস্ত্রকে পরিশোধিত করে চারটি ভাগে-অঙ্গ, উপাঙ্গ, মূল ও সূত্র-ভাগ করা হয়। এইসব গ্রন্থ প্রাকৃত ভাষায় রচিত।

(৭) শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর: জৈনরা শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। যেসব জৈন শ্বেতবস্ত্র পরতেন তারা শ্বেতাবর এবং যারা কোনো বস্ত্র পরতেন না তারা দিগম্বর নামে পরিচিত হন। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসে মৌলিক কোনো বিরোধ নেই, তবে আচারগত পার্থক্য অনেক।

(৮) জৈনধর্মের অবদান: ভারতের ইতিহাসে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে জৈনধর্মের প্রভাব অপরিসীম।

✓ প্রথমত, জৈনরাই প্রথম বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে সার্থক প্রতিবাদ গড়ে তুলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দেখিয়েছিলেন।

✓ দ্বিতীয়ত, ভারতে প্রথম জৈনরাই অহিংসার আদর্শ প্রচার করেছিলেন। বৈদিক ধর্মের আড়ম্বর অপেক্ষা আত্মার উৎকর্ষ সাধনের উপর জোর দিয়েছিলেন।

✓ তৃতীয়ত, আধুনিক পণ্ডিতদের মতে খ্রি.পূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পাঁচশো বছর ছিল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উত্থানের যুগ। এই অনুকূল ভারতের ইতিহাস পরিবেশ সৃষ্টির পিছনে জৈন ধর্মের অবদান অসীম। এই কারণে পশ্চিম ভারতে বড় শিল্পপতি ও বণিকদের একটা বিরাট অংশ আজও তাদের সাফল্যের জন্য মহাবীরের আশীর্বাদ আছে বলে মনে করেন।

✓ চতুর্থত, জৈনরা উচ্চবর্ণের সংস্কৃত ভাষা অপেক্ষা সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত ও অর্ধ-মগধী ভাষায় ধর্মপ্রচার করায় তামিল, তেলেগু, কানাড়ী, গুজরাটি প্রভৃতি ভাষাও সমৃদ্ধশালী হয়েছিল।

✓ পঞ্চমত, ভারতের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় জৈনদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উড়িষ্যার খণ্ডগিরি ও উদয়গিরি পাহাড়ের জেন শুহামন্দির, জুনাগড় ও ইলোরার জৈনমন্দির, রাজস্থানের আবু পাহাড়ে জোন মন্দির এবং কাগজের উপর প্রথম চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি ইত্যাদি সবই জৈনদের অবদান ছিল।

 মূল্যায়ন: বৈদিক ধর্মের কঠোরতা ও নানা অনাচারে যখন মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তখনই তারা জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জৈন ধর্ম খুর বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের ধর্ম-দর্শন ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে জৈনধর্ম বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।


ষোড়শ মহাজনপদ সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর:- বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে কোনো কোনো রাজশক্তি ছিল না। তবে এই সময় ভারতে ষোলটি ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এদেরকে একত্রে বলা হত ষোড়শ মহাজনপদ। এই মহাজনপদ গুলি বিস্তৃত ছিল কাবুল থেকে দাক্ষিণাত্যের গোদাবরী নদী পর্যন্ত। এই মহাজনপদগুলি হল-

(১) কাশি: ষোড়শ জনপদগুলির মধ্যে কাশি ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশাল জনপদ। এর রাজধানী ছিল বারানসি। জাতক থেকে কোশল এবং অঙ্গ ও মগঞ্জ রাজ্যের সাথে কাশির দ্বন্দ্বের কথা জানা যায়। গৌতম বুদ্ধের সময়ে কাশি রাজোর পতন ঘটে এবং কোশল কাশি অধিকার করে নেয়।

(২) কোশল: কোশল রাজ্যটি অবস্থিত ছিল বর্তমান অযোধ্যা অঞ্চলে। কোশর রাজ্যে উত্তরাঞ্চলের রাজধানী ছিল শ্রাবন্তী এবং দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী ছিল কুশাবতী। মগধের উত্থান পর্যন্ত কোশল ছিল উত্তরভারতের শ্রেষ্ঠ শক্তি। পরবর্তীকারে কোশল মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(৩) অঙ্গ: বর্তমানে বিহারের ভাগলপুর ও মুঙ্গের জেলা নিয়ে অঙ্গ রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল চম্পা। অঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্ত তার সমসাময়িক মগর পরাজিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে মগধরাজ বিম্বিসার এই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে এই রাজ্যটির ওপর মগধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত

(৪) মগধ: বর্তমানে বিহারের গয়া ও পাটনা জেলা নিয়ে মগধ রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল প্রথমে গিরিব্রজ পরবর্তীকালে রাজগৃহ ও পাটলিপুত্র। মগধ ছিল প্রসারণশীল সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। মগধকে কেন্দ্র করে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। হয়।

(৫) বৃজি : গঙ্গা নদীর উত্তরভাগ থেকে নেপাল পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড নিয়ে বৃজি রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল বৈশালী। আটটি গণরাজ্য নিয়ে বৃজি রাষ্ট্র সংঘ গঠিত হয়েছিল। এই রাজ্যটি ছিল একটি স্বয়ংশাসিত প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য। পরবর্তীকালে দীর্ঘ যুদ্ধের মাধ্যমে মগধ এই রাজ্যটিকে দখল করে নেয় এবং প্রজাতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটায়।

(৬) মুল্ল বা মালব: উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলায় মল্ল রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। বৃজি রাজ্যের মতো মল্ল ছিল প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ রাজধানী ছিল কুশীনগর ও পাবা। সম্ভবত বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু আমলে মল্ল মগধ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(৭) চেদি: যমুনা নদীর কাছে বর্তমান বুন্দেলখণ্ড ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে চেদি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল শুকতিমতি। পরবর্তী সময়ে চেদি রাজ্যটিও মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(৮) বৎস: বর্তমান উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদের কাছে গঙ্গার দক্ষিণতীরে বৎস্য রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল কৌশম্বী। বৎসের রাজা উদয়িন ছিলেন সেই সময়কার এক নাটকীয় ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীকালে বৎসরাজ্য মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(৯) কুরু: দিল্লি ও তার সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে কুরু রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কুরু রাজ্যের কোনো উল্লেখযোগ্য শাসক না থাকায় এই রাজ্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে কুরু রাজ্য মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(১০) মৎস: বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর, ভরতপুর এবং আলোয়ার নিয়ে মৎস রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল বিরাট নগর। মহাভারতের বিখ্যাত রাজা বিরাট এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পরবর্তীকালে এই রাজ্যটি চেদি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তারও ওপরে চেদি ও মৎস রাজ্য মগদ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(১১) শূরসেন যমুনা নদীর তীরে শূরসেন রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এই কাজ্যের রাজধানী ছিল বংশ রাজত্ব করত। পরবর্তীকালে শূরসেন রাজ্যটি মতের রায়েজ্যর অন্তর্ভুক্ত হয়।

(১২) অশ্বক: দক্ষিণভারতে গোদাবরী নদীর তীরে অস্মক রাজ্যটি গাড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল পোর্ট গোদাবরী নদীর কাকু বংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন বলে জানা যায়।

(১৩) অবন্তী: মালব ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে অবন্তি রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনীর নিবাই স্মৃতি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে অবন্তী মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

(১৪) গান্ধার: কাশ্মীর উপত্যকার গান্ধার রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল তক্ষশীলা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গান্ধারের রাজা ছিলেন পমকুসাতি। তিনি মগধরাজ বিম্বিসারের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে পারস্য সম্রাট দরয়েস গান্ধার রাজ্য অধিকার করে নেয়।

(১৫) কম্বোজ: দক্ষিণ-পশ্চিম কাশ্মীরে কম্বোজ রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল। এর রাজধানী ছিল রাজপুর। প্রারম্ভিকপর্বে কম্বোজে রাজতন্ত্র থাকলেও পরবর্তীকালে প্রজাতান্ত্রিক শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

 মূল্যায়ন: উপরের ষোলটি মহাজনপদের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা থেকে আভাস পাওয়া যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য একেবারেই ছিল না। ভারত অনেকগুলি খণ্ড, ক্ষুদ্র, বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তি না থাকায় এই রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের সঙ্গে সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। আর্যাবর্তে প্রাধান্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই রাজ্যগুলির মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল তাতে শেষ পর্যন্ত মগধ সাফল্য অর্জন করে।