হরপ্পাবাসী অর্থনৈতিক জীবন আলোচনা করো বা ব্যবসা বাণিজ্যের বিশেষ উল্লেখসহ হরপ্পার অর্থনীতি

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর আগে ভারতে প্রথম সভ্যতার উদয় হয়। এই সভ্যতার উদয় হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকা ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে। এই সভ্যতা ইতিহাসে হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক জীবন নিম্নে আলোচনা করা হল।


(১) কৃষি: হরপ্পাবাসীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির উর্বর মাটি কৃষিকার্যের জন্য বেশ অনুকূল ছিল। হরপ্পাবাসীরা নানা ধরনের ফসল ফলাতেন। হরপ্পাবাসীদের প্রধান প্রধান কৃষিজাত ফসল ছিল গম, যব, তিল, মটর, বাদাম, শাকসবজি প্রভৃতি। নদীতে বাঁধ দিয়ে জল প্রবাহকে সেচের কাজে ব্যবহার করা হত। শস্য বড়ো বড়ো গোলায় মজুদ করে রাখা হত।

(২) পশুপালন: হরপ্পার অর্থনীতিতে পশুপালনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। গরু ও মহিষকে তারা কৃষিকার্যে ও পণ্য ফসল পরিবহনে ব্যবহার করত। এছাড়াও ভেড়া, ছাগল, কুকুর, উট, ষাঁড়, বিড়াল, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি তাদের পোষ্য প্রাণীর তালিকায় ছিল। তবে ঘোড়াকে এই সভ্যতার মানুষ পোষ মানাতে পারেনি বলে মনে করা হয়। এই সভ্যতার একেবারে শেষদিকে অবশ্য কালিবাগানে ঘোড়ার কঙ্কালের অস্তিত্ব মিলেছে।

(৩) শিল্প: হরপ্পাবাসী মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প এবং বস্ত্রবয়ন শিল্পে বেশ দক্ষ ছিল। প্র কুমোরের চাকার সাহায্যে লাল, হলুদ, বাদামী বহু বিচিত্র রমের মাটির বা মৃৎপাত্র তৈরি করা হত। সেগুলিকে পুড়িয়ে শক্ত করা হত। থালা, গ্লাস, বাটি, জগ, কলসি, মাছ, নারীমূর্তি প্রভৃতি তৈরি করা হত। পাত্রগুলির গায়েও নানা জ্যামিতিক নকশা, পশুপাখি ও লতা পাতার চিত্র আঁকা হত। তামা ও ব্রোঞ্জের ধাতু দিয়ে কাস্তে, কুঠার, বাসনপত্র, মূর্তি, কলসি বানানো হত। হরয়ায় ১৬টি তামা গলানোর অগ্নিকুণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। লোখালে আবিষ্কৃত হয়েছে তাম্রকারদের কর্মশালা। লোখালে দুটি যাতব দ্রব্য আবিষ্কৃত হয়েছে, যার ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে হরপ্পাবাসী লৌহ গলানোর কৌশল সম্পর্কে অবহিত ছিল। হরপ্পাবাসীর সোনা ও রূপার অলংকারগুলিতে দক্ষতার ছাপ বেশ স্পষ্ট ছিল। হরপ্পাবাসীর অন্যতম পেশা ছিল বয়ন শিল্প। সম্ভবত হরপ্পাবাসী সর্বপ্রথম সুতিবস্ত্র তৈরি করে। তুলো থেকে সুতো তৈরি করে উন্নতমানের বস্ত্র বিদেশে রপ্তানি করা হত।

(৪) ব্যবসা বাণিজ্য: সিন্ধুবাসীরা ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ উন্নত লাভ করেছিল। হরপ্পার দক্ষ ও শ্রেষ্ঠ বণিকদের বলা হত পনি। আভ্যন্তরীন বাণিজের ক্ষেত্রে মহেঞ্জোদাড়োতে দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সুষ্ঠু ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নগরের বিভিন্ন স্থানে বিপণি ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। অভ্যন্তরীন পণ্য পরিবহনে উট, গাধা, গরু প্রভৃতি পশুকে ব্যবহার করা হত। হরপ্পাবাসী বৈদেশিক বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটিয়েছিল। ইরান, আফগানিস্তান, বালুচিস্তান প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশ থেকে হরপ্পাবাসী আমদানি করত সোনা, রূপা, টিন, দামী পাথর ইত্যাদি। আর পশ্চিম এশিয়ার মেসোপটেমিয়া, সুমের, ব্যাবিলন, ক্রিট প্রভৃতি প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতাগুলিতে রপ্তানি করতো সুতির বস্ত্র, তামা, হাতির দাঁত, মূল্যবান পাথর, ময়ূর প্রভৃতি। লোথাল ছিল হরপ্পাবাসীর প্রধান বাণিজ্য বন্দর। এই সময় মুদ্রার প্রচলন না থাকায় বিনিময় প্রথার মাধ্যমে বাণিজ্য চলত।

মূল্যায়ন: উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে হরপ্পাবাসীর আর্থিক অবস্থা খুবই ভালো ছিল। সিন্ধু উপত্যকার অনুকূল পরিবেশ হরপ্পাবাসীকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করে তুলেছিল। হরপ্পাবাসীর হাত ধরেই এক সক্রিয়, গতিশীল ও বহুমুখী আন্তর্জাতিক অর্থনীতি সূচনা হয়েছিল।


হরপ্পাবাসীর ধর্মীয় জীবন আলোচনা করো।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ভারতে প্রথম সভ্যতার উদয় হয়। এই সভ্যতার উদয় হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকা ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে। ইতিহাসে এই সভ্যতা হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। মাটি খুঁড়ে যেসব মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করে পণ্ডিতগণ হরপ্পা সভ্যতার ধর্মীয় জীবনের প্রতি আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। 

(১) ধর্মীয় বিশ্বাস: হরপ্পাবাসী বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিল, নাকি এক দেবতায়। বিশ্বাসী ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত দেব-দেবীর মূর্তিগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে এই সময় মাতৃমূর্তির পূজা কর হত। বিভিন্ন হাতি, বাঘ, মহিষের ছবি দেখে মনে করা হয় যে সেই সময় পশুকেও পূজা করা হত। এছাড়াও হরপ্পাবাসীরা লিঙ্গ ও বৃক্ষ উপাসনায় বিশ্বাসী ছিল।

(২) প্রতীক পূজা: পণ্ডিতদের মতে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা বিভিন্ন প্রাকৃতির শক্তির পূজা করত। যেমন নদী, অগ্নি, জল, সর্প প্রভৃতি। তাদের মধ্যে টোটো বা প্রতীক পূজার প্রচলন ছিল। হরপ্পায় প্রতীক পূজার কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন ক্ষুদ্রাকৃতির পাথরের গায়ে যোনিচিহ্ন, লিঙ্গের আকৃতি বিশিষ্ট পাথরখণ্ড প্রভৃতি। হরপ্পাবাসী বৃক্ষও পূজা করত। তারা মূলত অশ্বত্থ বৃক্ষের উপাসনা করত।

(৩) মূর্তিপূজা: হরপ্পা সভ্যতায় বিভিন্ন মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল। যেমন দেবীমূর্তি, দেবমূর্তি এবং নর-পশু মূর্তি।

(ক) দেবীমূর্তি: বিভিন্ন সিলমোহরে নারীমূর্তি খোদিত চিত্র দেখে মনে করা হয় যে হরপ্পা সভ্যতায় মাতৃকাদেবী ও তার মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। এই নারীমূর্তির পায়ে ধুপের ধোঁয়া ও প্রদীপের চিহ্ন পাওয়া গেছে। হরপ্পায় নরবলি চিহ্নিত একটি সিল পাওয়া গেছে যা থেকে মনে করা হয় যে দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। এই মূর্তিটির উদর থেকে একটি চারাগাছ প্রসার লাভ করেছে। পণ্ডিতরা এটিকে উর্বরতর দেবী বা ভূ-মাতা বলে মনে করেন।

(খ) দেবমূর্তি: হরপ্পায় একটি সিলমোহরে এমন একটি দেবমূর্তি পাওয়া গেছে যার তিনটি মুখ এবং মাথায় দুটো শিং আছে। তিনি যোগীর আসনে বসে আছেন। তাকে পাঁচটি পশু বেষ্টন করে আছে। ঐতিহাসিক এ.এল. ব্যাশাম একে আদি শিব বা পশুপতি বলে উল্লেখ করেছেন।

(গ) নর-পশু মূর্তি: হরপ্পায় একটি সিলে একটি অর্ধ-নর - অর্ধবৃষ (ষাঁড়) মূর্তিকে বাঘের সাথে লড়াইরত ছবি পাওয়া গেছে। হরপ্পাবাসী এই মূর্তিটিকেও দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। ষাঁড় ছিল হরপ্পাবাসীদের কাছে বেশ পবিত্র।

(ঘ) ধর্মীয় প্রতীক সমূহ: হরপ্পবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে পদ্ম, স্বস্তিকা চক্র, স্তম্ভ ও ত্রিশূল প্রভৃতি প্রতীক বা চিহ্ন জড়িত ছিল। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাতে বেশ কয়েকটি সিলে স্বস্তিকা চিহ্নিত এবং সিং বিশিষ্ট মাথার ছবি পাওয়া গেছে। এছাড়া বেলুচিস্তানে কেজ উপত্যকায় স্বস্তিকা চিহ্ন বিশিষ্ট কিছু মাটির পাত্র পাওয়া গেছে।

(ঙ) পারলৌকিক বিশ্বাস হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে কিছু মন্ত্রঃপুত কবচের মতো দেখতে বস্তু পাওয়া গেছে। এগুলি দেখে মনে করা হয় যে হরপ্পাবাসী অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত। বজ্রপাত, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি ঘটনাকে তারা অলৌকিক শক্তির রোষের কারণ বলে মনে করত। হরপ্পায় একটি বড়ো আকারের কবরখানা আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিস্থ করার প্রথায় মৃতদেহের সাথে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও অলংকারাদি কবরে রাখা হত। মৃতদেহ সাধারণত উত্তর থেকে দক্ষিণে শায়িত করে সমাধিস্থ করা হত। অবশ্য মৃতদেহকে দাহ করার রীতিও হরপ্পায় চালু ছিল।

মূল্যায়ন: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে হরপ্পা সভ্যতায় ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। হরপ্পার সমাজজীবনে ধর্মের গভীর রীতি লক্ষ্য করে বলা যায় যে মেসোপটেমিয়া বা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার মতো হরপ্পা সংস্কৃতিও ধর্মের উপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছিল।

হরপ্পার সমাজজীবন ও রাজনৈতিক জীবন আলোচনা

আজ থেকে প্রায় আড়াই -সাড়ে চার হাজার বছর আগে ভারতে প্রথম সভ্যতার উদয় হয়। এই সভ্যতার উদয় হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকায় ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে। এই সভ্যতা হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত।

(ক) হরপ্পার সমাজজীবন: হরপ্পার সিলমোহরে যে লিপি ববহৃত হয়েছে তা আজও পাঠোদ্ধার হয়নি। তাই হরপ্পার সমাজজীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। হরপ্পার সমাজজীবন সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা নিম্নে আলোচনা করা হল।

(১) শ্রেণিবিভক্ত সমাজ হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলিতে শ্রেণিবৈষম্য ছিল। বড়ো বড়ো প্রসাদ, দুর্গ এবং ছোটো ছোটো বাড়িগুলির অবস্থান শ্রেণিবৈষম্যের পরিচয় দেয়। কবরের প্রকারভেদও এই শ্রেণিবৈষম্যের প্রমাণ দেয়। এই বিভাজন অনুসারে হরপ্পার নাগরিক সমাজ মূলত চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা পুরোহিত শ্রেণি, কৃষক শ্রেণি, বণিক শ্রেণি ও কারিগর শ্রমিক শ্রেণি। সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে ছিল ক্রীতদাস শ্রেণি। খাদ্য মাড়াই ও বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করা হত।

(২) খাদ্যসামগ্রী: হরপ্পার অধিবাসীরা গম ও যবের তৈরি খাবার খেত। অল্পবিস্তর ধানের চাষ হত ফলে চাল থাকায় ভাতও তাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা বিভিন্ন পশুর মাংস, দুধ, খেজুর প্রভৃতি খাদ্য হিসাবেকরত। সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে আঙুর ও আনারস উৎপাদিত হত। সিন্ধু অঞ্চলে তামার বড়শির নিদর্শন মেলায় মনে করা হয় মাছ ও কচ্ছপের মাংস তাদের খাদ্য ছিল।

(৩) পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকার: সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত মূর্তি থেকে সে যুগের পোশাক পরিচ্ছদের নিদর্শন পাওয়া যায়। পোশাকের উপরদিকটা সালের মতো এবং নিচের অংশটি ধুতির মতো দেখতে হত। নারী এবং পুরুষের পোশাকের মধ্যে তেমন কিছু তফাৎ ছিল না। পুরুষ ও নারী সকলেই লম্বা চুল রাখত। নারীরা চুলে হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনি লাগিয়ে রাখত। তারা চোখে সুরমা টানতে জানত। নারীরা অলংকার পড়তে ভালোবাসত। বিচিত্র রকমের আংটি, দুল, চুরি, গলার হার অলংকার হিসাবে ব্যবহার করা হত। অলংকার নির্মাণে সোনা, রূপা এবং নানারকমের মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করা হত।

(৪) দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জিনিস সিন্ধু সভ্যতার মাটির পাত্র, চিনামাটির পাত্র, রুপো ও ব্রোঞ্জ নির্মিত পাত্র প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জিনিস পাওয়া গেছে। সেই সময় নানাপ্রকার তীর, ধনুক প্রভৃতি জিনিস ব্যবহৃত হত। খাট, চেয়ার, টেবিল, টুল এবং আলো দিয়ে বৈঠক ঘর সাজানো হত।

(৫) বিনোদন: সিন্ধু উপত্যকায় মার্বেল পাথরে তৈরি এক ধরনের বল ও পাশা আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা এগুলি ছিল হরপ্পা বা সিন্ধুবাসীদের খেলার সরঞ্জাম। প্রাপ্ত বেশ কিছু সিলমোহরে শিকারের দৃশ্য রয়েছে। এই শিকারের দৃশ্যগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে তাদের বিনোদনের আরো এক মাধ্যম ছিল শিকার করা। চিত্ত বিনোদনের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে নাচ-গান, ষাঁড় ও পাখির লড়াই আয়োজিত হত।

(৬) জীবিকা: সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের জীবিকা ছিল কৃষি ও পশুপালন। এছাড়া বহু মানুষের কথা জানা যায় যারা শিল্পকলা নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন।হরপ্পা বা সিন্ধুসভ্যতার সমাজব্যবস্থা ছিল খুবই রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতার জন্যই সুমেরিয়র সঙ্গে হরপ্পার নগরগুলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকলেও হরপ্পাবাসী নিজেদের কারিগরি ও সেচব্যবস্থা তেমন কিছু উন্নতি ঘটায়নি। এর ফলে একটা সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এর ফলে হরপ্পা সভ্যতার পতন হয়। 

(খ) হরপ্পার রাজনৈতিক জীবন: সিন্ধু উপত্যকায় অনেক সিলমোহর পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলি পাঠ করা যায়নি। তার ফলে হরপ্পাবাসীর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। হরপ্পা সভ্যতার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এককেন্দ্রিকতা। মহেঞ্জোদারো হোক বা হরপ্পা হোক সর্বত্রই একই ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। অথচ এই দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৬৪০ কিমি। এই অখণ্ডতা ধরা পড়েছে নগর বিন্যাসে, জল নিকাশি ব্যবস্থায়, শস্য সংগ্রহ ও বণ্টনে, ওজনে ও মাপে, ইটের আকারে, পাথরের ও ধাতুর যন্ত্রপাতিতে। এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় যন্ত্র ছাড়া বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ওই ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ওই শাসন যন্ত্রের চূড়ায় যিনি ছিলেন তিনি রাজা না পুরোহিত না অন্য কোনো এক পুরোহিত রাজা বা কোন অভিজাত গোষ্ঠী তা জানা যায় না। তবে শাসনযন্ত্রের প্রধান যিনি বা যারাই হোক না কেন সারা অঞ্চলে যে এক বিশাল আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মূল্যায়ন: হরপ্পাবাসীর জীবনে ধর্মের একটি মুখ্য ভূমিকা ছিল। এর থেকে মনে করা হয় রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় পুরোহিত সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অনেকে বলেন শাসনকার্যের সুবিধার জন্য রাষ্ট্রটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটি অংশের রাজধানী ছিল মহেঞ্জোদাড়ো এবং অপরটি হরপ্পা। তবে এই ধরনের অভিমত প্রমাণসিদ্ধ নয়। তবে সুষ্ঠু প্রশাসনের স্বার্থে রাষ্ট্রটি যে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল তা বোধহয় অস্বীকার করা যায় না। কেউ কেউ মনে করেন যে হরপ্পার নগরগুলিতে বণিকদের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ গিল্ড বা শ্রমিক সংঘ এখানকার শাসন পরিচালনা করত। উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে হরপ্পায় শাসনব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। সেই কারণেই এই সভ্যতার প্রায় প্রত্যেকটি নগর কেন্দ্রে একই ধরনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।