আর্যদের আদি অবস্থান বা আর্য-সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা

ভারতের ইতিহাসে যেসব জটিল বিতর্কিত বিষয় আজও পর্যালোচনা ও গবেষণার স্তরে থেকে গেছে তার মধ্যে একটি হল আর্যদের বাসস্থান। আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মূলত দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। একদল ঐতিহাসিক মনে করেন আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল ভারত আর অন্য একদল ঐতিহাসিক মনে করেন আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল ইউরোপ বা অন্যান্য কোনো দেশে।

(১) আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে যে সমস্ত ঐতিহাসিক মনে করেন যে আর্যদের আদি অবস্থান ভারতে, তাদের যুক্তিগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

✓ প্রথমত, যারা দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যায় তারা তাদের আদি দেশের কথা গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করে। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে সপ্তসিন্ধু ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাম পাওয়া যায় না।

✓ দ্বিতীয়ত, বৈদিক সাহিত্যে যে সকল গাছ ও পশু পাখির উল্লেখ আছে তা ভারতের সকল স্থানে দেখা যায়।

✓ তৃতীয়ত, যদি ভারতের বাইরে আর্য জাতি বাস করত তবে বৈদিক সাহিত্যের মতো তাদের একটি সাহিত্য তাকত। কিন্তু এইরকম কোনো সাহিত্য ভারতের বৈদিক সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও নেই।

✓ চতুর্থত, আর্যরা যাগ-যজ্ঞ ভিত্তিক ধর্মানুষ্ঠান করত যা একমাত্র ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না।

✓ পঞ্চমত, ঋকবেদের নদী স্তোত্রে যে নদ-নদীর নাম আছে তা পূর্বদিক থেকে প্রথমে গঙ্গা দিয়ে শুরু এবং পূর্ব-পশ্চিমে সরস্বতীর নাম দিয়ে শেষ। সুতরাং এই নদী-স্তোত্র প্রমাণ করে যে পূর্ব ভারত থেকে আর্যরা উত্তর-পশ্চিম যাত্রা করেছিল।

✓ ষষ্ঠত, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভুত হলেও তার কোনো প্রভাব ইউরোপীয় ভাষাগুলির ওপর পড়েনি। যদি আর্যরা আদিতে ইউরোপে বসবাস করত তবে ইউরোপের ভাষায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটত।

(২) আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে নয় যে সকল ঐতিহাসিক মনে করেন যে আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে নয় তাদের যুক্তিগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

✓ প্রথমত, আর্যজাতির ভারতে আদি বসবাস সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

✓ দ্বিতীয়ত, প্রাক্ ঐতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা হল বৈদিক সভ্যতা থেকে পৃথক এবং উন্নত। যদি আর্যরা প্রথম থেকেই ভারতে বসবাস করত তাহলে কখন এবং কিভাবে এই হরপ্পা সভ্যতা স্থাপিত হল সে কথা বৈদিক সাহিত্যে নিশ্চয়ই বলা হত। বরং এটি প্রমাণিত যে আর্য সভ্যতা অপেক্ষা হরপ্পা সভ্যতা প্রাচীন এবং আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসকারী। এই তথ্য প্রমাণ করে যে আর্যরা বহিরাগত। 

✓ তৃতীয়ত, ভারতে যদি আর্যদের আদি বাসস্থান হত তাহলে তারা ভারতের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আগে সমস্ত ভারতে বসতি স্থাপন করত। কিন্তু আর্যরা দক্ষিণভারতে তাদের বসতি স্থাপন করেনি।

✓ চতুর্থত, বৈদিক সাহিত্যে সিংহের কথা আছে কিন্তু বাঘ ও হাতির উল্লেখ নেই। আর্যরা যদি প্রথম থেকেই ভারতে থাকত তাহলে ভারতের এই দুটি প্রাণীর নাম বৈদিক সাহিত্যে নিশ্চয়ই তারা উল্লেখ করত।

✓ পঞ্চমত, সংস্কৃত ভাষায় তালব্য ধ্বনির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সঙ্গে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক ভাষার মিশ্রণ ঘটেছিল, ভারত আর্য ভাষার উৎসভূমি হলে এমনটি হওয়া উচিত ছিল না।

ইউরোপ বা অন্যান্য দেশ আর্যরা যে বহিরাগত তার পক্ষে বহু মত রয়েছে। ম্যাক্স মুলার বলেছেন, পশ্চিম এশিয়া আর্যদের আদি বাসভূমি। পি. গাইলস বলেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কর্পেথিয়ান পর্বতমালার পূবে অর্থাৎ অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও বোহেমিয়া অঞ্চলেই আর্যদের আদি নিবাস। ডক্টর রামশরণ শর্মার মতে ফ্রান্সের আলপাস পাহাড়ের পূর্বে আর্যদের আদি বসবাস ছিল। অধ্যাপক হার্ট মনে করেন ইউরোপ থেকে আর্যদের একটি শাখা ককেশাস পর্বত অতিক্রম করে ইরান বা পারস্য ও ভারতে বসবাস শুরু করেছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে রাশিয়ার দক্ষিণে বিশাল তৃণভূমি আর্যদের বাসভূমি।

 মূল্যায়ন: সুতরাং আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায়? এই প্রশ্নটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। আর্যদের বাসস্থান নিয়ে বর্তমানেও নানা ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা চলছে। কিন্তু আজও সেরকম কোনো সঠিক যুক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের সমাজজীবন আলোচনা করো।

উত্তর:- বৈদিক সভ্যতা ভারতীয় আর্যদের সৃষ্টি। আর্য বলতে কোনো জাতিকে বোঝায় না। আর্য হল এক প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠী। গ্রিক, হিব্রু, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ইরানীয় এই পাঁচটি ভাষাকেই আর্য বলা হয়। সংস্কৃত ভাষাভাষী আর্যরা আনুমানিক দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত করেন। বৈদিক সভ্যতা বা বৈদিক যুগ দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা- (ক) আদি বৈদিক বা ঋক বৈদিক যুগ ও (খ) পরবর্তী বৈদিক যুগ।

 ঋকবৈদিক যুগের সমাজজীবন: ঋকবেদ ও তার সমসাময়িক অন্যান্য সূত্র থেকে ঋকবৈদিক যুগের সমাজজীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায়।

(১) পরিবার: ঋক বৈদিক যুগে সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি ছিল পরিবার। 

পরিবারগুলি ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারকে বলা হত কুল। পরিবারের সর্বাপেক্ষ বয়স্ক পুরুষ ছিলেন পরিবারের সর্বময়কর্তা। তাকে গৃহপতি বা কুলপ বলা হয়। পরিবারের সকলে তার নির্দেশ অবনত মস্তকে পালন করত। যৌথ পরিবার ছিল আর্য সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পিতা, মাতা সহ, পিতামহী এবং অন্যান্য পরিজন নিয়ে পরিবার গঠিত হত। পরিবারের প্রত্যেকের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

(২) গৃহ: ঋক বৈদিক যুগের সভ্যতা ছিল গ্রামীণ সভ্যতা। প্রতি পরিবারের স্থায়ী গৃহ থাকত। সাধারণত গৃহগুলি বাঁশ, খড় ও শনের ছাউনি দ্বারা তৈরি করা হত। পরবর্তীকালে মাটির দেওয়াল দ্বারা গৃহ নির্মাণের প্রথা চালু হয়। প্রতি গৃহে একটি করে অগ্নিকুণ্ড থাকত। এই অগ্নিকুণ্ড পোড়া মাটির ইটের দ্বারা তৈরি করা হত।

(৩) বিবাহ: সাধারণত পিতামাতা বিবাহের পাত্রপাত্রী নির্বাচন করে দিতেন। অনেকক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীর পরস্পরের পছন্দকে বিবাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হত। সমাজে বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ ছিল না। তবে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের একাধিক বিবাহের উদাহরণও পাওয়া যায়। বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল। সমাজে পণপ্রথা চালু ছিল।

(৪) বর্ণপ্রথা: আর্যরা প্রথম যখন ভারতবর্ষে আসে তখন তারা নিজেদের দেহের আকৃতি, গায়ের রং প্রভৃতি সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিল। আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ। আর ভারতের অধিবাসীরা ছিল কৃষ্ণবর্ণ। বৈদিক যুগের প্রথম দিকে সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা- (ক) গৌরবর্ণ বিজেতা আর্য ও (খ) কৃষ্ণবর্ণ বিজিত দাস। কিন্তু জনসংখ্যা ও সামাজিক জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুণ, কর্ম ও বৃত্তি অনুসারে সমাজে চারটি বর্ণের উদ্ভব হয়। যথা-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা শাস্ত্রপাঠ ও যাজযজ্ঞ করত তারা হল ব্রাহ্মণ। যারা যুদ্ধ ও রাজ্য শাসন করত তারা হল ক্ষত্রিয়। যারা ব্যবসা বাণিজ্য করত তারা হল বৈশ্য আর অনার্য দাসগণ শূদ্র নামে পরিচিত ছিল। উক্ত তিন শ্রেণির মানুষেরা পরস্পর বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হতে পারত। তারা যে কোনো বৃত্তি বা জীবিকা গ্রহণ করতে পারত।

(৫) চতুরাশ্রম: প্রথা বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের প্রতিটি ব্যক্তির জীবন চারটি স্তরে বা আশ্রমে বিভক্ত ছিল। এই চারটি স্তর বা আশ্রম হল, যথা- (ক) ব্রহ্মচর্য (খ) গার্হস্থ্য (গ) বাণপ্রস্থ (ঘ) সন্ন্যাস।

(ক) ব্রহ্মচর্য: ব্রহ্মচর্য ছিল অধ্যয়নের সময়। এই সময় আর্য বালক গুরুগৃহে বাস করে ব্রহ্মচর্য পালন ও বিদ্যাচর্চা করত।

(খ) গার্হস্থ্য: গার্হস্থ ছিল যৌবনে গৃহী হয়ে সংসার ধর্ম পালন করা।

ধর্মানুষ্ঠানে ও ঈশ্বরচিন্তায় কালযাপন।

(গ) বানপ্রস্থ: বানপ্রস্থ ছিল প্রৌঢ় বয়সে সংসার ত্যাগ করে অরণ্যবাসী হয়ে

(ঘ) সন্ন্যাস: শেষ জীবনে সন্ন্যাস অবলম্বন করে পরমাত্মার চিন্তায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখা।

(৬) নারীর অবস্থান: সমাজে নারীর স্থান ছিল সম্মানজনক। অন্তঃপুরের যাবতীয় কাজ তাদের যেমন করতে হত, তেমনি অন্তঃপুরের বাইরেও তারা পুরুষদের সহায়তা করতেন। স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ বেদমন্ত্র রচনা, ধর্ম ও শাস্ত্রচর্চায় অংশগ্রহণ করত। লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ নারী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

(৭) খাদ্য: আর্যদের খাদ্যাভাস ছিল সাধারণ ও অনাড়ম্বর। আর্যদের খাদ্য ছিল দুধ, ঘি, ফলমূল, যব, গম ও নানা প্রকার পশুপক্ষীর মাংস। পিঠা ছিল আর্যদের প্রিয় খাদ্য। সুরা ও সোমরস ছিল প্রিয় উত্তেজক পানীয়। তবে সুরাপান সমাজে নিন্দনীয় ছিল।

(৮) আমোদ প্রমোদ নাচ, গান, রথের দৌড়, পাশাখেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, ধনুর্বাণ প্রতিযোগিতা প্রভৃতি ছিল আর্যদের আমোদ প্রমোদের প্রধান উপকরণ।

(৯) সংগীত চর্চা: বৈদিক যুগে সংগীত বিদ্যা ও চারুকলার খুবই উন্নতি হয়েছিল। বাঁশি, বীণা, ঢোল, ঢাক প্রভৃতি সংগীতের সময় ব্যবহার করা হত। সামবেদকে গানের আকারে গাওয়ার রীতি ছিল।

(১০) পোষাক পরিচ্ছদ ও অলংকার পশুর চামড়া দিয়ে আর্যরা পোষাক তৈরি করত। পোশকের তিনটি অংশ ছিল। যথা-অন্তর্বাস, নিম্নাঙ্গের পোশাক, উর্ধ্বাঙ্গের পোশাক। নারী ও পুরুষ উভয়ে অলংকার পরত। সোনা, রূপা ও দামী পাথরের অলংকার ব্যবহার করা হত।

 মূল্যায়ন: বৈদিক যুগে আর্যদের সহজ সরল সামাজিক জীবন পরবর্তী সময়ে ক্রমশ জটিল হতে শুরু করে। ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে নানা অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠতে দেখা যায়।