বৈদিক সভ্যতা ভারতীয় আর্যদের সৃষ্টি। আর্য বলতে কোনো জাতিকে বোঝায় না। আর্য হল এক প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠী। গ্রিক, হিব্রু, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ইরানীয় এই পাঁচটি ভাষাকেই আর্য বলা হয়। সংস্কৃত ভাষাভাষী আর্যরা আনুমানিক দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে করেন। বৈদিক সভ্যতা বা বৈদিক যুগ দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা- (ক) আদি বৈদিক বা ঋক বৈদিক যুগ ও (খ) পরবর্তী বৈদিক যুগ।
ঋকবৈদিক যুগের রাজনৈতিক জীবন: ঋকবেদ ও তার সমসাময়িক অন্যান্য সূত্র। থেকে ঋকবৈদিক যুগের রাজনৈতিক জীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায়।
(১) উপজাতি: ঝকবৈদিক যুগে কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হত গোষ্ঠী। কয়েকটি গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হত উপজাতি। ঋকবৈদিক যুগে উপজাতিই ছিল সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তর বা রাষ্ট্র। ঋক বৈদিক যুগে উপজাতি ও উপজাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সৃঞ্জয়, অনু, পুরু, ভরত, যদু, তুর্কস প্রভৃতি।
(২) রাজতন্ত্রের উৎপত্তি ঋকবৈদিক যুগে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে যেমন সংঘর্ষ চলত তেমনি ভূমি ও গো-সম্পদের দখল নিয়েও বিভিন্ন আর্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ চলত। এককথায় সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। এই অবস্থার অবসান ঘটানো এবং যুদ্ধজয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী নেতার প্রয়োজন দেখা দেয়। এইভাবেই ঋকবৈদিক সমাজে রাজতন্ত্রেরউৎপত্তি ঘটে।
(৩) দশ রাজার যুদ্ধ: ঋকবেদে দশ রাজার যুদ্ধে আর্যদের দলগত সংগ্রামের উল্লেখ আছে। এই যুদ্ধে ভরতরাজ সুদাস দশটি আর্য রাজাদের মিলিত বাহিনীকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধ আর্যদের রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধের পর থেকে আর্যদের মধ্যে সার্বভৌম রাজশক্তির ধারণা সৃষ্টি হয়।
(৪) রাজনৈতিক কাঠামো: ঋকবৈদিক যুগে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের সর্বনিম্ন একক ছিল পরিবার বা কুল। এর কর্তাকে বলা হত কুলপতি। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠত গ্রাম। এর কর্তাকে বলা হত গ্রামনী। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠতগোষ্ঠী। এর কর্তাকে বলা হত রাজন বা রাজা।
(৫) রাজার ক্ষমতা ও দায়িত্ব: ঋকবৈদিক যুগে রাজা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তার প্রধান কাজ ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও অভ্যন্তরীন শত্রুদের হাত থেকে প্রজাবর্গের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করা। এছাড়া তাকে শাসনকার্য পরিচালনা, যুদ্ধ পরিচালনা, ধর্মরক্ষা, রাজস্ব আদায় প্রভৃতি কাজ করতে হত।
(৬) সভা ও সমিতি : ঋকবৈদিক যুগে রাজা সর্বশক্তিমান হলেও কখনোই স্বৈরাচারী ছিলেন না। তাকে সব বিষয়ে সভা ও সমিতি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মত নিয়ে চলতে হত। সভা ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানবৃদ্ধদের প্রতিষ্ঠান এখানে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। সমিতির অধিবেশনে গোষ্ঠীর সকল মানুষ যোগ দিতে পারত। সমিতির অধিবেশনে উপস্থিত থাকা রাজার কর্তব্য বলে বিবেচিত হত। রাজা সর্বদা সমিতির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করত।
(৭) রাজকর্মচারীগণ রাজা রাজ্যের শাসন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মচারীর সাহায্য নিতেন। এইসব কর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পুরোহিত, সেনানী, ব্রজপতি, গ্রামনী, গুপ্তচর, দূত প্রভৃতি। সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় কার্যে পুরোহিতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরোহিতের পরেই ছিল সেনানী বা প্রধান সেনাপতি। তার কাজ ছিল যুদ্ধের সময় রাজাকে সাহায্য করা। শান্তির সময় তাকে অসামরিক কাজকর্ম করতে হত। গ্রামনী ছিলেন গ্রামের শাসনকর্তা। ব্রজপতি গোচারণভূমি দেখাশোনা করত। গুপ্তচররা রাজাকে রাজ্যের নানা বিষয়ে অবহিত করত। দূত কূটনৈতিক কাজে রাজাকে সাহায্য করত।
(৮) সেনাবাহিনী: সেনাবাহিনীর তিনটি পদ ছিল-পদাতিক, অশ্বারোহী ও রথারোহী বাহিনী। ঋকবৈদিক যুগে কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। প্রয়োজনে একটি গোষ্ঠীর সব পুরুষই যুদ্ধযাত্রা করত। মেয়েরাও যুদ্ধে অংশ নিত। যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে তির ধনুক, বল্লম, তলোয়ার, বর্ম, শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি ব্যবহার করা হত। যুদ্ধাস্ত্রগুলি ছিল লৌহনির্মিত। অশ্বের প্রচলন ছিল। সামরিক কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অসামরিক কাজও করতে হত।
(৯) রাজস্ব ব্যবস্থা: ঋকবৈদিক যুগে কোনো নিয়মিত কর ব্যবস্থা ছিল না। রাজার আয়ের উৎস ছিল বলি। বলি কোনো কর নয়-দান, প্রণামী বা উপহার। প্রথমে বিশেষ বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠানে রাজাকে বলি পাঠানো হত। বলি পাঠানো বাধ্যতামূলক ছিল না। পরবর্তীকালে বলি পাঠানো আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়।
(১০) বিচার ব্যবস্থা: পুরোহিত ও অন্যান্য কর্মচারীর সাহায্য নিয়ে রাজা বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। অপরাধীকে ধরে আনার জন্য পুলিশ ছিল। তাদের উগ্র বলা হত। পারস্পরিক বিবাদের বিচারে যিনি মধ্যস্থতা করতেন তাকে বলা হত মধ্যমাসি। গ্রামে বিচারকের কাজ করত গ্রাম্যবাদিন। রক্তপাত জনিত অপরাধের শাস্তি ছিল একশোটি গরু।
মূল্যায়ন: সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ঋকবৈদিক যুগে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাজা ও রাজ্যের উৎপত্তি হয়েছিল। সেই সময় রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র উভয় ছিল। রাজার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল না।
ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন আলোচনা
বৈদিক সভ্যতা ভারতীয় আর্যদের সৃষ্টি। আর্য বলতে কোনো জাতিকে না। আর্য হল এক প্রাচীন ভাষা গোষ্ঠী। গ্রিক, হিব্রু, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ইরানীয় এই পাঁচাও ভাষাকেই আর্থ বলা হয়। সংস্কৃত ভাষাভাষী আর্যরা আনুমানিক দেড় হাজার খ্রিস্টপূর্বায়ে বোঝাছ ভারতে বৈদিক সভ্যতার সূত্রপাত করেন। বৈদিক সভ্যতা বাই বিভক্ত। যথা- (ক) আদি বৈদিক বা ঋক বৈদিক যুগ ও (খ) পরবর্তী বৈদিক যুগ। বৈদিক যুগ দুটি
ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন: ঋকবেদ ও তার সমসাময়িক অন্যান্য সূত্র থেকে ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায়।
(১) কৃষি: নদী উপত্যকার উর্বর পলিমাটি অঞ্চলে আর্যরা বসবাস গড়ে তুলেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই কৃষি আর্যদের প্রধান জীবিকা হয়ে উঠেছিল। ঋকবেদ থেকে জানা যায় আর্যরা লাঙল দিয়ে জমি কর্ষণ, বীজ বপন, শস্য কর্তন সার ও জলসেচের ব্যবহারে বেশ অভিজ্ঞ ছিল। ধান ও যব প্রধান কৃষিজাত শসা হলেও ধান চাষের প্রণালী অনার্যদের কাছ থেকে তারা শিখেছিল। জমিতে জলস্যে গুলোর দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রথমদিকে গ্রামবাসী গ্রামের জমি সমষ্টিগত ভাড়ে। ও নারত ও ফসল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত। কিন্তু ক্রমে জমি গ্রামের চান্ডের পরিবারের দখলে চলে যায় এবং এইভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার উত্তর হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও উত্তরাধিকার সূত্রে জমি ভোগদখলের সমস্যার উদ্ভব হয়।
(২) পশুপালন : বৈদিক যুগে দ্বিতীয় প্রধান জীবিকা ছিল পশুপালন। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে প্রধান ছিল গরু। সে যুগে যমুনা নদীর তুই তীরস্থ অঞ্চল গোসম্পদের জন্য সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিল। গোধন দ্বারা মানুষের সম্পদ নির্ধারিত হত। এমনকি সৈনিকরাও যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্য হিসাবে গোসম্পদই সর্বদা অধিক কামনা করত। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘোড়া ও ভেড়ার গুরুত্বও যথেষ্ট ছিল।
(৩) শিল্প: ঝকবৈদিক যুগে কৃষি প্রধান জীবিকা হলেও সমাজের প্রয়োজনে অন্যান্য বৃত্তিরও উদ্ভব হয়েছিল। ঋকবেদে সূত্রধর, ধাতুশিল্পী, চর্মকার, তন্তবায়, রথনির্মাতা, অস্ত্রনির্মাতা ইত্যাদি কারুশিল্পীর উল্লেখ আছে। গৃহপালিত পশু ভেড়া লোম থেকে পশমবস্ত্র তৈরি করত তত্ত্ববায়েরা। যুদ্ধ ও যাতায়াতের জন্য রথের ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং এর জন্য রথ নির্মাতা নামক একটি পৃথক কারিগর সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। কর্মকাররা তামা ও ব্রোঞ্জের সাহায্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করত। এই সময় কম হলেও লোহার ব্যবহার হত।
(৪) ব্যবসা বাণিজ্য: ঋকবেদ থেকে আর্যদের বাণিজ্যের কথা জানা যায়। ঋকবৈদিক যুগে বৈশ্য ও অনার্য পনি বণিক সম্প্রদায় ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিল। জলপথে নৌকা ও সামুদ্রিক জাহাজ এবং স্থল পথে গরু • ঘোড়ার গাড়ী বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। ঋকবেদে উল্লেখ আছে শত অরিত্র অর্থাৎ একশত দাঁড় বিশিষ্ট সামুদ্রিক জাহাজ এবং সর্তমা নৌঃ অর্থাৎ নদী পাড়ি দেবার বৃহদায়তন নৌকার ব্যবহার ছিল। সমুদ্র পাড়ি দেবার বিশাল আকৃতির নৌকাকে ঋকবেদে শৌরাবতী নৌঃ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
(৫) বিনিময় প্রথা: ঝকবৈদিক যুগে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে দু'ধরনের স্বর্ণখণ্ড মনা ও নিষ্ক-এর প্রচলন থাকলেও উন্নত মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য পণ্য বিনিময় প্রথা গড়ে ওঠে। তবে গরু ছিল এই বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। ঐতিহাসিক এ.এল. বাসাম বলেন তখন নিয়মিত ব্যবসায়ী এবং সুদখোর বা মহাজন সম্প্রদায় না থাকায় সুনিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না। তাই পণ্য বিনিময় প্রথার মাধ্যমে আমদানী রপ্তানী ধাণিজ্য দুই-ই চলত।
(৬) অন্যান্য বৃত্তি: ঋকবেদ থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষের কথা জানা যায়। এইসব পেশা বা বৃত্তিভিত্তিক পেশাদাররা হলেন বাসোবাঢ়, ভিষ্ক, কর্মার, কার্মার, দ্রবি, ভারভূত, বপ্তা, মালাকার ইত্যাদি।
মূল্যায়ন: উপরের আলোচনা থেকে সহজেই মনে হয় আর্যদের অর্থনীতির মধ্যে মিশ্র অর্থনীতির ধারণা ছিল। তবে গতানুগতিক নানা বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যাশাম আর্যদের অর্থনীতিকে যুগের তুলনায় অগ্রগামী ছিল না বলে মনে করেন।