মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই বিজ্ঞান মানুষের সহযাত্রী। সম্ভবত খ্রিস্ট ২৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতে বিজ্ঞানের সূচনা হয়। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্র ও পুরাণে বৈজ্ঞানিক চর্চার কম বেশি উল্লেখ রয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের নবদিগন্তের সূচনা হয়েছিল। প্রাচনী ভারতে বিভিন্ন যুগে বিজ্ঞানচর্চার অস্তিত্ব নিম্নে আলোচিত হল-
(ক) সিন্ধু সভ্যতার যুগে বিজ্ঞানচর্চা: সিন্ধুসভ্যতার যুগে চিকিৎসা চর্চায় কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। এই যুগের কিছু কিছু মূল্যবান আয়ুর্বেদিক ঔষধ আর পণ্যের নমুনা পাওয়া গেছে। গবেষকদের ধারণা আয়ুর্বেদের সূচনা সিন্ধু যুগেই। সিন্ধু উপত্যকায় কয়লার মতো কালো রঙের একরকম দ্রব্য কয়েকটি মৃৎপাত্র সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। শিলাজিতের সঙ্গে এই দ্রব্যের সাদৃশ্য রয়েছে। শিলাজিৎ একটি মূল্যবান ঔষধ। এই যুগে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার গণিতবিদ্যার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল।
(খ) বৈদিক যুগে বিজ্ঞানচর্চা: বৈদিক যুগে বিজ্ঞানচর্চার বহু প্রমাণ পাওয়া
যায়। সেই সময় গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করা হত। সূর্যের উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন অনুধাবন করে ঋতুর কাল নির্ধারণ এবং বছর গণনা করা হত। সেই সময় বছরকে বারো মাসে ভাগ করা হত এবং প্রতি মাসকে ত্রিশ দিনে ভাগ করত। এই চিকিৎসা চর্চায় যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। প্রচলিত ছিল গাছ-গাছড়ার সাহায্যে চিকিৎসা। সেই যুগে যজ্ঞের বেদী নির্মাণ ও কাল নির্ণয়ের জন্য জ্যামিতিক গণিত ও জ্যোতিষ চর্চা শুরু হয়েছিল।
(গ) প্রাক্-মৌর্যযুগে বিজ্ঞান চর্চা: প্রাক মৌর্যযুগে দর্শন চিন্তাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান চর্চার উন্নতি ঘটেছিল। এই সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুসারে রোগের চিকিৎসা ও রোগীর সেবা ছিল ঘৃণ্য কাজ। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানচর্চায় দেখা দেয় বন্ধ্যা দশা। এই অচল অবস্থা থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত করে তাতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধের ব্যক্তিগত বন্ধু ও চিকিৎসক ছিলেন জীবক। এই সময় চিকিৎসা পদ্ধতি ঔষধ ও পণ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রকৃত বিজ্ঞানের পথে চলেছিল। এই সময় ভেষজ বিজ্ঞানচর্চারও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। এই যুগে প্রথম হাসপাতালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
(ঘ) মৌর্য যুগে বিজ্ঞানচর্চা: মৌর্য যুগে বিজ্ঞানচর্চার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র' থেকে জানা যায় সেই সময় কৃষিবিভাগ কোন্ জায়গায় কত বৃষ্টিপাত হয় তা পরিমাপ করে শস্য বপণ করত। কৌটিল্য তাঁর 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উল্লেখ করেছেন। যেমন-সাধারণ চিকিৎসক, বিষক্রিয়া চিকিৎসক, সৈন্যদের চিকিৎসক প্রভৃতি। মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা' গ্রন্থ থেকে জানা যায় সেই সময় পশু চিকিৎসার বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। সম্রাট অশোক মানুষ ও পশু উভয়ের চিকিৎসার জন্য অভাবনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্য থেকে জানা যায় যে সেই সময় যুদ্ধে আগ্নেযাস্ত্রের ব্যবহার হত।
(ঙ) কুষাণ যুগে বিজ্ঞানচর্চা: কুষাণ যুগে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল। কুষাণ যুগে ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম জনক চরকের আবির্ভাব ঘটেছিল। রাজবৈদ্য চরক তাঁর গ্রন্থে গাছপালা ও খনিজ দ্রব্যের ভেষজ গুণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। এই যুগে শল্যবিদ সুশ্রুতর আবির্ভাব ঘটেছিল। 'সুশ্রুত সংহিতা' থেকে জানা যায় যে সুশ্রুত অতি জটিল ও কঠিন নানা ধরনের
অস্ত্রোপচারে পারদর্শী ছিলেন।
(চ) গুপ্তযুগে বিজ্ঞানচর্চা: গুপ্তযুগে বিজ্ঞানচর্চার অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ গণিতশাস্ত্রবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট গুপ্তযুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রথম পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি আবিষ্কার করেন। তিনি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। এছাড়া গুপ্তযুগে আর্যভট্ট প্রণীত 'আর্য সিদ্ধান্ত' এবং বরাহমিহির প্রণীত 'সূর্যসিদ্ধান্ত' ও 'বৃহৎ সংহিতা' গ্রন্থ জ্যোতির্বিজ্ঞানের অমূল্য সম্পদ। চিকিসাশাস্ত্রেও গুপ্ত যুগে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছিল। চিকিৎসাশাস্ত্রের কিংবদন্তী ধন্বন্তরী গুপ্তযুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মূল্যায়ন: সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অস্তিত্ব সব যুগেই ছিল। প্রাচীন বৈজ্ঞানিক উন্নতি যথেষ্ট হয়েছিল। সমকালীন বহু দেশের তুলনায় এই উন্নতি ছিল অধিকতর বিস্তৃত এবং গুণগত দিক থেকে অধিকতর উৎকর্ষ সম্পন্ন। তবে বর্তমান কালের মতো এত দ্রুত বেগে বিজ্ঞানের উন্নতি প্রাচীনকালে সম্ভব ছিল না।
ইতিহাসে স্থানের গুরুত্ব আলোচনা করো বা ইতিহাস ও স্থানের সম্পর্ক আলোচনা করো।
মানুষকে কেন্দ্র করে যে সকল কর্মকাণ্ড আবর্তিত ও বিবর্তিত হয় তার সবই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। তাই সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্পস্থাপত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান সবই স্থান পায় ইতিহাসের আলোচনায়। তবে ইতিহাসের আলোচনার সঙ্গে যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে অন্যতম হল স্থান।
ইতিহাস হল মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত। মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খোঁজ পাওয়া যায় পৃথিবীর নানা অঞ্চলে। তাই ইতিহাস আলোচনায় স্থান বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। মানুষের কর্মকাণ্ড যেখানে বা যে সময় সংগঠিত হোক না কেন সেক্ষেত্রে স্থানের গুরুত্ব থাকবেই। কারণ মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। এই সমাজ গড়ে ওঠার পেছনে একটি নির্দিষ্ট স্থান থাকে। তাছাড়া সমাজের সকল মানুষ মিলে যে রাষ্ট্র গঠন করে তার প্রধান শর্তগুলির মধ্যে স্থান হল অন্যতম। তাই সকল দিক বিচার করে এ কথা বলা যায়, ইতিহাসের ক্ষেত্রে স্থানের গুরুত্ব অপরিহার্য।
ইতিহাস আলোচনার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মাধ্যমে ইতিহাস নির্মিত হলে সেখানে স্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে নিদর্শনের প্রাপ্তিস্থান বিশ্লেষণ করাটা বেশ জরুরি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, একটি নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন মুঘল আমলের নিদর্শনের সাথে মিশে গেল, কিন্তু একে যদি কোনো প্রস্তর যুগের হাতিয়ার সমাবেশে আবিষ্কার করা যেত সেখানে নিদর্শনটিকে বলা যেত প্রস্তর যুগের। এই কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ইতিহাসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে স্থানকে যথেষ্ট গুরুত্ব
দেওয়ার কথা বলেছেন।
আধুনিককালে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল প্রেক্ষিত। এই প্রেক্ষিত বিশ্লেষণের জন্য তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, এগুলি হল-স্থান, সময় ও অবস্থা। আধুনিককালের প্রত্নতাত্ত্বিকগণ স্থানকে স্থানিক প্রেক্ষিত হিসাবে বর্ণনা করে থাকেন এবং অবস্থা বিচারে স্থান প্রেক্ষিতের তিনটি বিষয়ের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে নতুন গড়ে ওঠা প্লাবনভূমিতে হাজার বছর পূর্বে প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ স্থান বিচার না করে কোনো
ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দান থেকে বিরত থাকবেন। এখানে যদি দেখা যায় আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই ভূমিরূপের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি প্রাচীন সেক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হবে এইরকম, যদি দেখা যায় ভূমিরূপ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স একই বা ভূমির বয়স প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের থেকে বেশি সেক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স নিয়ে আর কোনো সমস্যা থাকে না।
মূল্যায়ন: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট যে ইতিহাসের আলোচনায় স্থানের গুরুত্ব অপরিহার্য। ভোগৌলিক সীমারেখা ভিত্তিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক স্থান বা দেশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন, ভারতের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, এশিয়া মহাদেশের ইতিহাস, আফ্রিকার ইতিহাস প্রভৃতি। প্রতিটি দেশের নিজস্ব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভৌগোলিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এর সাথে মানুষের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র পরিবর্তন ঘটে। সেই কারণে ইতিহাসচর্চায় স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম।