পরিবেশ কথার অর্থ হচ্ছে আমাদের পরিপার্শ্ব, যার মধ্যে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উভয় উপাদানই বর্তমান। মানুষের কাজকর্মের উপর পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। কিন্তু তাই বলে মানুষের সব কাজ পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত হয় ভাবলে ভুল হবে। পরিবেশের প্রভাবও মানুষের জীবনধারার উপর প্রবলভাবে পড়ে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে আঘাত বা ব্যবহার না করে আমরা প্রাচীন যুগেও কোনও মানবসমাজের অগ্রগতির কথা চিন্তা করতে পারি না। ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বসতি সাধারণভাবে গড়ে উঠেছিল হ্রদ বা নদীর পাড়ে, পাহাড়ী এলাকায় মালভূমিতে, অরণ্য অঞ্চলে যেখানে মানুষজন তাদের জীবিকার প্রয়োজনে পাথর অথবা হাড় দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করতে পারত। এইসব হাতিয়ার শিকার, মাটি খোঁড়াখুড়ি করা, গৃহ নির্মাণের কাজেও ব্যবহৃত হত। এ কথা বলা যায় জীবন ধারণের জন্য প্রাচীন ভারতের মানুষ প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করেছিল। সেই সূত্রে প্রকৃতির সাথে তার এবং তার পোষিত পশু শ্রেণির পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়।
(ক) বৈদিক সাহিত্যে প্রকৃতি: আদি বৈদিক সাহিত্যে দেবতাকে প্রকৃতির প্রকাশ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। প্রকৃতিকে বলা হয়েছে জীবনের উৎস। প্রাচীন ভারতবর্ষে নদীগুলিকে দৈব বলে ভক্তি করা হয়। ঋকবেদে সরস্বতী নদীকে দেবী রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈদিক যুগের পরবর্তীতে মাতৃদেবী হিসাবে আবির্ভূতা হন গঙ্গা। এখনও সেইপরম্পরা সমানে চলছে। যেহেতু মৃত্তিকা এবং জল উভয়ই উদ্ভিদ এবং পশুপাখিকে লালন করে তাই তাদের মাতৃরূপে দেখা হয়। ঋকবেদের সংহিতায় প্রকৃতির আনুকূল্যে প্রার্থনা করা হয়েছে। মানুষ কামনা করেছে-বায়ু মধুময় হোক, দিন-রাত, আকাশ-সূর্য, গাছ-পাতা, পশু-পাখি, ধূলিকণা সবই মধুময় হোক। বৈদিক যুগে কৃষির বিস্তার বনাঞ্চলে আঘাত হেনেছিল। 'অগ্নি বৈস্বানরের' সাহায্যে জঙ্গল পুড়িয়ে জমি হাসিল করতে গিয়ে 'পৃথু-বৈন্য' পরিবেশের উপর চাপ তৈরি করেছিলেন।
(খ) রামায়ণ ও মহাভারত কাব্যে প্রকৃতি: রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডে বলা হয়েছে যে, কেবল পাঁচটি পঞ্চনখা প্রাণী 'ভাগ্য' বাকি সব 'অভাগ্য'। স্বীকৃত পাঁচটি পঞ্চনখা প্রাণী-সজারু, গণ্ডার, গোসাপ, খরগোশ, কচ্ছপ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী, বধ করা যাবে না। মহাভারতের উদ্যোগপর্বে শিকারের উপর কয়েকটি অবশ্যমান্য বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন- (ক) কোনো বনজঙ্গলের ভিতরে ঢুকে হিংস্র অথবা অহিংস্র প্রাণী বধ করা ধর্মবিরোধী। (খ) লোকালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কেবল হিংস্র প্রাণী শিকারযোগ্য (গ) যেসব বনাঞ্চলে শক্তিশালী পশুর বাস, সেখানকার গাছপালা কাটা অপরাধ ইত্যাদি।
রামায়ণ এবং মহাভারত এই দুটি কাব্যেই প্রকৃতি ও মানুষকে একই মঞ্চের শরিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেকালে সমাজে ধারণা ছিল গাছপালা জীবন্ত, তারা মানুষ বা অন্য প্রাণীর মতোই। মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে-গাছপালার স্পর্শানুভূতি আছে, তাই উঞ্চস্পর্শে গাছের পাতা, বাকল ও ফল শুকিয়ে যায়। ঝড়-বজ্রপাতে তারা আহত হয়, গর্জনে তারা আতঙ্কিত হয় অর্থাৎ গাছেরা শুনতে পায়। রামায়ণে বলা হয়েছে বিশ্বামিত্র মুনির বোন সত্যবতীই আসলে কৌশিকী নদী। সুচরিত্রের কারণে তিনি পবিত্র রূপ পেয়েছেন।
(গ) বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে: পরিবেশ বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনেও পরিবেশ সম্পর্কে একই ধরনের চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। জৈন দর্শনে বৃক্ষকে জীবপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। জৈন দর্শনের কল্পবৃক্ষের ধারণা বৌদ্ধ দর্শনেও আছে। বৌদ্ধ সূত্রে বলা হয়েছে যে, বৃক্ষ ও জল এই দুইয়ের উপাসনার মধ্য দিয়ে মগধের শাসকগোষ্ঠী সাফল্য লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্মেও বৃক্ষপূজা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আরও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল প্রাচীন সাহিত্যেই গবাদি পশু হত্যাকে নিন্দা করা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ সুত্তনিপাত নামক পালি সাহিত্য গ্রন্থে গরুকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে গবাদি পশুরা উদ্ভিদের ফলনে সাহায্য করে, জনগণকে খাদ্য ও শক্তি যোগায়। পশুর ব্যাপকহারে হত্যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, তাই তিনি গোহত্যা নিবারণ করতে বলেছিলেন। পশুবলি রোধ করে বৌদ্ধধর্ম জীবমণ্ডলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার পক্ষে কাজ করেছিল এর ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
(ঘ) গুপ্তযুগে পরিবেশ: গুপ্তযুগে জমির উপর ব্যক্তিসমূহের সামন্ত অধিকার স্বীকার করে নেওয়ার সময় দেবোত্তর সম্পদের ধারণার বিকাশ ঘটেছিল। আসলে দেবতার অজুহাতে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করবার উপজাতীয় পদ্ধতিরই এটা ছিল উচ্চবর্গীয় সংস্করণ। ভারতের বনবাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বৃক্ষপূজার প্রচলন ছিল তারই উচ্চবর্গীয় সংস্করণ হিসাবে বিকশিত হয়েছিল 'পর্জন্যপূজা', 'নদীপূজা' বা 'মূর্তিপূজার' ধরন। এই কারণে কৃষির বিস্তার হওয়া সত্ত্বেও বহু বনাঞ্চল বনবাসী সম্প্রদায় অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতে পরিবেশের ভারসাম্যের অভাব তেমনভাবে ঘটেনি।
মূল্যায়ন: প্রাচীন ভারতের মানুষ যে তার পরিবেশ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন তার পরিচয় প্রায় সব ধরনের সাহিত্য ও দর্শনগ্রন্থে আছে। শুধু ধর্মীয় গ্রন্থই নয়, বিভিন্ন লেখকদের লেখনিতে সেই পরিচয় সবসময়ই পাওয়া গেছে। যেমন, কালিদাস ও ভবভূতি তাঁদের কাব্য-নাটকে প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুধু জীবন নাট্যের পশ্চাদপট হিসাবে দেখেননি, দেখেছিলেন জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে। প্রাচীন ভারতের বনবাসী সম্প্রদায়ের ধর্ম, যাদুবিশ্বাস, দেবতার উদ্দেশ্যে বনকে উৎসর্গ করা, উর্বরতা তত্ত্বের প্রয়োগে বৃক্ষপূজা বা শিলা পুজো-এসবই মানুষ ও পরিবেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই পরিচায়ক।
প্রাচীন ভারতে ইতিহাস রচনার সাহিত্যিক উপাদানগুলিআলোচনা করো।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি হল-প্রত্নতাত্ত্বিক
উপাদান ও সাহিত্যিক উপাদান। সাহিত্যিক উপাদানগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) দেশীয় সাহিত্য এবং (২) বিদেশি সাহিত্য।
(ক) দেশীয় সাহিত্য:- দেশীয় সাহিত্যগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-(১) ধর্মীয় সাহিত্য (২) জীবনী সাহিত্য (৩) বিবিধ সাহিত্য এবং (৪) আঞ্চলিক
সাহিত্য বা ইতিহাস।
(১) ধর্মীয় সাহিত্য: আর্যদের আগমনের পর থেকে আলেকজান্ডারের আগমন পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের প্রধান উপকরণ বা উপাদান হল ধর্মীয় সাহিত্য।
(ক) বৈদিক সাহিত্য ধর্মভিত্তিক সাহিত্যের মধ্যে প্রধান হল বৈদিক সাহিত্য। বৈদিক যুগের সাহিত্যগুলি হল চতুর্বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। এই সাহিত্যগুলি থেকে বৈদিক যুগে আর্যদের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
(খ) রামায়ণ ও মহাভারত : রামায়ণ ও মহাভারত ভারতের প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় মহাকাব্য। রামায়ণ থেকে জানা যায় আর্য সভ্যতা দক্ষিণে সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। মহাভারত থেকে আর্যদের সভ্যতা ও রাজনৈতিক বিস্তারের কথা জানা যায়।
(গ) পুরাণ: পুরাণ থেকে মধ্যদেশের বিভিন্ন রাজাদের সম্পর্কে জানা যায়। পুরাণ থেকে হস্তিনাপুরের কৌরব রাজগণ, কৌশলের ইক্ষবাকু রাজগণ ও শৈশুনাগ রাজগণ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্যাদি পাওয়া যায়। পুরাণ থেকে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা, বহু প্রাচীন শহর, যবন ও হুণ জাতির পরিচয় পাওয়া যায়।
(ঘ) বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ: বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-দীপবংশ, মহাবংশ, জাতক। দীপ বংশ ও মহাবংশ থেকে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও আশোক সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। জৈন ধর্মগ্রন্থ দ্বাদশ অঙ্গ, জৈন ভগবতী সূত্র, জৈন কল্পসূত্র প্রভৃতি থেকে সমকালীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনীতি সম্পর্কে জানা যায়।
(২) জীবনী সাহিত্য: রাজাদের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য বা গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। হর্ষবর্ধনের জীবনী ভিত্তিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বাণভট্টের হর্ষচরিত। চালুক্য বংশীয় রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি বিলহনের রচিত 'বিক্রমাদিত্য চরিত্র' থেকে রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কথা জানা যায়। পাল বংশের রাজা রামপাল সম্পর্কে সন্ধ্যাকর নন্দী রচনা করেন 'রামচরিত'। চালুক্য রাজা কুমার পালকে নিয়ে জৈন আচার্য জয়সিংহ রচনা করেন 'কুমারপাল চরিত'।
(৩) বিবিধ সাহিত্য বিবিধ সাহিত্য বলতে বোঝায় নাটক, কাব্য ইত্যাদি। মহাকবি কালিদাস রচিত রঘুবংশ, ধোয়ী রচিত পবনদূত, কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র, পানিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী, গার্গী রচিত গার্গী সংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অপ্রত্যাশিত ভাবে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
(৪) আঞ্চলিক সাহিত্য বা ইতিহাস: প্রাচীন ভারতের একমাত্র প্রকৃত ইতিহাসগ্রন্থ হল কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী। রাজতরঙ্গিনী থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়। সোমেশ্বর রচিত 'রাসমালা' থেকে গুজরাটের ইতিহাস জানা যায়। দক্ষিণ ভারতের ইতিাস জানতে 'তামিল সঙ্গম সাহিত্য' খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(খ) বিদেশি সাহিত্য: গ্রিক, রোমান, চৈনিক, তিব্বতীয়, আরবীয় প্রভৃতি বৈদেশিক লেখক ও পর্যটকদের বিবরণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-প্লিনির 'প্রাকৃতিক ইতিহাস' মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা', ফা-হিয়েনের 'ফো কুয়োকিং', হিউয়েন সাঙের 'সি-ইউ-কি', অল বিরুনীর 'তহকিক-ই-হিন্দ' প্রভৃতি। এই গ্রন্থগুলি থেকে সমসাময়িককালের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস জানা যায়।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানের তথ্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের কাহিনী কিংবদন্তী কাহিনী থেকে পৃথক করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধুমাত্র সাহিত্যিক উপাদান দিয়ে ইতিহাস রচনা করা যায় না। তবে ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা থাকলেও সাহিত্যগত উপাদানের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস রচনায় সাহিত্য উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম।