আদি বা প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা কিভাবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তা আলোচনা করো।


 
উত্তর:-  ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের গৌরবকে অনেক ক্ষেত্রে ধ্রুপদী সংস্কৃতি রূপে উল্লেখ করা হয়। আবার অনেকে এই প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সমাজ সভ্যতার বিবর্তন ধারাকে ধীশক্তি সম্পন্ন বলে উল্লেখ করেছেন।

জন লুবেক প্রথম প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসের ব্যাখ্যা দেন। এই প্রেক্ষিতে প্রাগৈতিহাসিক ভারতের ইতিহাসের সূচনা হয় আনুমানিক প্রায় আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে। এই যুগের কোনো লিখিত উপাদান পাওয়া যায় না। দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষার ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে আকারে ইঙ্গিতে কথা বলত। কিন্তু সে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষার কোনো লিখিত রূপ ছিল না। তাই প্রাগৈতিহাসিক ভারতের জীবন সংস্কৃতি রসায়ন জানার অন্যতম উপাদান হল প্রত্নতাত্তিক উপাদান, বিশেষত গাছের ডাল ও প্রস্তর নির্মিত হাতিয়ার, মৃৎশিল্প, বাসস্থান, গৃহস্থালির সরঞ্জাম প্রভৃতি। এছাড়া জীবাশ্ম, গুহাচিত্র, সমাধিস্থান, ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতিকে প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয়দের আদি বা প্রারম্ভিক ইতিহাসের উপাদান বলা হয়।

ভারতের মাটিতে মানবাকার আধুনিক প্রজাতির উদ্ভব হয় আজ থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে। প্রাগৈতিহাসিক এই মানুষদের বলা হয় 'গুহা মানব'। এরা প্রথমে পাহাড়ের গুহাতে বসবাস করত। গুহাগুলি পর্যাপ্ত না থাকায় ডালপালা, লতাপাতা, হাড়, বাঁশ, মাটি প্রভৃতি দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করত। কখনো চামড়ার ছাউনি দিয়ে তারা ঘর বাঁধত।

শিকারী গুহা মানবরা ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। পাথর ও পশুর হাড় দিয়ে তৈরি হাতকুঠার, ছুরি, বর্শা, তীর-ধনুক প্রভৃতি হাতিয়ার দিয়ে তারা শিকার সংগ্রহ করত। বন্যপশুর মাংস, ফলমূল ছাড়াও নদীর মাছ, পাখির ডিম, শাকসবজি তারা দলবদ্ধভাবে শিকার ও সংগ্রহ করত। একই গুহায় বসবাসকারী বা প্রতিবেশী সঙ্গে রক্তের সম্পর্কযুক্ত শিকারীদের নিয়ে দল গঠন করত। এই দলগুলিকে 'ক্ল‍্যান' বলা হত। আবার বড়ো কোনো জন্তু শিকারের জন্য সহযোগী কয়েকটি গোষ্ঠী জোটবদ্ধ হত, তাকে 'কৌম' বলা হত। একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে শিকার করত। প্রথমে

নারী-পুরুষ সকলে একসাথে শিকার করলেও পরবর্তীতে নারীদের জন্য ঘর, দৈনন্দিন জীবন এবং গৃহপালিত পশু প্রতিপালন নির্দিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। আর পুরুষেরা বরাবর শিকারের কাজে নিযুক্ত হয়। আরো পরবর্তীতে অবশ্য কৃষিকাজে পুরুষ-নারী উভয়ে হাত ধরাধরি করে শ্রম দেয়।

গুহাবাসী ভারতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল আগুনের আবিষ্কার। দাবানল ও আগ্নেয়গিরির আগুন থেকে তারা আগুনের ব্যবহার শেখে। এর ফলে শিকারী মানুষ কাঁচা মাংসকে আগুনে পুড়িয়ে খেত। মাটির পাত্র তৈরি করে রান্নার কাজে তারা আগুন ব্যবহার করে। মাটির পাত্র নির্মাণে তখনো তারা কুমোরের চাকার ব্যবহার শেখেনি বলা হয়। আগুনের ভয় দেখিয়ে তারা হিংস্র পশুকে তাড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়ায়। আগুনের আবিষ্কার যেমন জীবনের নিরাপত্তা বাড়ায়, তেমনি


প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থান।

উত্তর:- প্রাচীন ভারতের কোনো ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়নি। তাই প্রাচীন ভারতে নারীদের অবস্থান জানার জন্য যেসব উপাদানগুলির উপর নির্ভর করতে হয় তা হল-সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। বিভিন্ন সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি পরীক্ষা করে প্রাচীন ভারতে নারীদের অবস্থান বা মর্যাদা সম্পর্কে যে চিত্র পাওয়া যায় তা নিম্নে আলোচিত হল-

(ক) সিন্ধু সভ্যতার যুগে নারী ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হল সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার যুগে নারীদের অবস্থান বা মর্যাদা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। যেটুকু জানা যায় তা হল সিন্ধু সভ্যতায় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সেই সময় মাতৃদেবীর পূজা হত। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারত। কৃষিকার্যে ও কারিগরী শিল্পে নারী ছিল পুরুষের সহযোগী।

(খ) ঋক-বৈদিক যুগে নারী ঋক-বৈদিক আর্য সমাজে নারীরা যথেষ্ট মর্যাদা ভোগ করত। তবে নারীরা স্বাধীন হলেও স্বেচ্ছাচারী ছিল না। সমাজে বিষপলা ও মুদগলানীর মতো রণকুশলী নারী যেমন ছিল তেমনি বিদুষী রমণীদের মধ্যে গার্গী, মৈত্রেয়ী, মমতা, অলাপার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। নারীদের আজীবন বিদ্যাচর্চার সুযোগ ছিল। পরিণত বয়সে নারীদের বিবাহ হত। বাল্যবিবাহ ও বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল না। কন্যাপণ, নারীদের বহুবিবাহ প্রথা ও সতীদাহ প্রথা শুধুমাত্র রাজপরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পিতৃ সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার ছিল। স্ত্রীকে ছাড়া স্বামী কোনো ধর্মাচরণ করত না।

(গ) পরবর্তী বৈদিক যুগে নারী: পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি, বরং হ্রাস পেয়েছিল। নারীরা ধর্মাচরণে অংশগ্রহণ করার অধিকার হারিয়েছিল। নারীদের বাল্যববাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদির শিকার হতে হয়েছিল। নারীরা পিতৃ সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। গৃহকর্ম ছাড়া আর অন্য কোনো বৃত্তি নারীরা গ্রহণ করতে পারত না। বলা বাহুল্য যে, পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীরা হয়ে উঠেছিল সন্তানের জননী ও ভোগ্যবস্তু।

(ঘ) মৌর্য ও মৌর্যোত্তর যুগে নারী: মৌর্য যুগে নারীরা বিবাহের আগে পিতামাতা এবং বিবাহের পরে স্বামীর অভিভাবকত্বে থাকত। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে ৭ বছর বয়সে নারীরা সন্তান প্রসব করত এবং ৪০ বছর বয়সে তারা বৃদ্ধাবস্থা লাভ করত। মনুসংহিতা অনুসারে ৩০ বছর বয়স্ক পুরুষ ১২ বছর বয়স্কা নারীকে বিবাহ করবে এবং ২৪ বছর বয়স্ক পুরুষ ৮ বছর বয়স্কা নারীকে বিবাহ করবে। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে নারী-পুরুষের বিবাহ আবশ্যিক কর্তব্য। স্ত্রী বন্ধ্যা হলে, কোনো পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ না করলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারত। এই সময় নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ চালু ছিল। নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে কখনো কখনো গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করত। গণিকাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা হত।

গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে নারী: গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে রচিত বিভিন্ন সাহিত্য থেকে সেই সময় নারীদের অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এ যুগে স্ত্রী কখনোই তার স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারত না। স্বামীর মৃত্যুর পর পবিত্র জীবনযাপন করা স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরের

ভারতের ইতিহাস

বিনা অনুমতিতে বিধবা স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে পারত না। হিউয়েন-সাঙ এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে সেই সময় নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথা চালু ছিল না। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগে স্বয়ংবর সভা প্রচলিত ছিল। নারীরা অন্তঃপুরবাসিনী ছিল। এই যুগে নারীদের বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদির শিকার হতে হয়েছিল। নারীদেরকে পিতৃ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কেবলমাত্র উচ্চবংশীয় নারীরা বিদ্যাচর্চা করতে পারত। নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে কখনো কখনো গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করত। সেই যুগে কোনো কোনো প্রাচীন মন্দিরে দেব-দাসী থাকত।

মূল্যায়ন

সুতরাং সামাজিক বিচারে বলা যায় যে প্রাচীন ভারতে নারীদের অবস্থান খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। বিভিন্ন যুগে নারীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে কম বেশি কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। তবে প্রতিটি যুগেই ভারতবর্ষের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে থাকার চিত্রটি পরিস্কার। সময় যত এগিয়েছে নারীদের মর্যাদা ততই ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে।