তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের বৈশিষ্ট্য।

বিবর্তনের গতি অনুসরণ করে মানুষ ধাতুর ব্যবহার শিখল। ধাতুর মধ্যে মানুষ প্রথম ব্যবহার করতে শেখে তামা। তামা ব্যবহারের কিছুকাল পরে মানুষ তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে আরো শক্ত ধাতু ব্রোঞ্জ আবিষ্কার করে। মেসোপটেমিয়া, মিশর, ভারত এবং চৈনিক সভ্যতায় ব্রোঞ্জের আবিষ্কার হয়। ধীরে ধীরে ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক ও উত্তর জার্মানিতে এর বিস্তার ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত ব্রোঞ্জযুগ স্থায়ী ছিল।

ব্রোঞ্জযুগের বৈশিষ্ট্য: ব্রোঞ্জযুগের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-

(১) নগর সভ্যতা: ব্রোঞ্জ যুগে নগরসভ্যতা আরো বিকশিত হয়। নগরায়নের ফলে শ্রমবিভাগের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। শ্রম বিভাগকে কেন্দ্র করে সমাজে পৃথক শ্রেণিবিভাজন ও স্তরবিন্যাস গড়ে ওঠে।

(২) শাসন ব্যবস্থা ও আইন: শ্রেণিবিন্যাস বিস্তৃত হওয়ায় সমাজ কাঠামোতে গুণগত পরিবর্তনের সূচনা হয়। বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশঙ্কায় নগরের চারপাশ প্রাচীর স্থাপন করা হয়। তীব্র শ্রেণিবিন্যাস, দাসভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থা, অতিরিক্ত কর আদায়ের প্রয়োজনে কঠোর ও শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়। রাজাকে শাসনকার্য পরিচালনায় পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসে পুরোহিত শ্রেণি। সমাজে তাদের বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৩) অর্থনীতি: ব্রোঞ্জযুগে কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। দ্রব্য বিনিময়ের পরিবর্তে ব্রোঞ্জের তৈরি মুদ্রা অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। সেচ ও বাঁধ 

(8) লেখা আবিষ্কার: ব্রোঞ্জ যুগে লেখা আবিষ্কার হয়। ফলে শিক্ষা ও জ্ঞানরাজ্যে নতুন যুগের আগমন ঘটে।

 হরপ্পা সভ্যতার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর অগে ভারতে প্রথম সভ্যতার উদয় হয়। এই সভ্যতার উদয় হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকা ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে। এই সভ্যতা সুপ্রাচীন চৈনিক, মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার সমসাময়িক। ইতিহাসে এই সভ্যতা হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করে হরপ্পা সভ্যতার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি জানা যায়।

(১) নগর পরিকল্পনা: হরপ্পা সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তার নগর পরিকল্পনা। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, চানহুদাড়ো, লোথাল, কালিবঙ্গান ও বানাওয়ালীর মতো উন্নত মানের নগরগুলি এই পর্বেই গড়ে উঠেছিল। নগরগুলির গঠন ও বিন্যাস দেখে মনে হয় নগর পরিকল্পনা তখন পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রাথমিক স্তরে ছিল না, অনেক উন্নতমানের ছিল। শহরগুলির মধ্যে প্রধান ছল মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা।

(২) নদীমাতৃক: হরপ্পা সভ্যতাটি ছিল নদীমাতৃক। হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদের উপত্যকায় ইরাবতীর তীরে আর মহেঞ্জোদারো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদের তীরে। হরপ্পা সভ্যতা নদীমাতৃক হবার মূল কারণ ছিল নদী সারা বছর ধরে জলের প্রয়োজন মেটায়। তাছাড়া নদী কৃষি ও বাণিজ্যিক পক্ষে সহায়ক।

(৩) তাম্র ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা: হরপ্পা সভ্যতা হল তাম্র ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতা হল এমন এক যুগের সভ্যতা, যখন বিভিন্ন হাতিয়ার বা জিনিসপত্র তৈরির কাজে পাথরের পরিবর্তে তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার করা হয়েছে।

(৪) কৃষি: হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। নদীর জল ও ভুগর্ভস্থ জল কৃষিকাজে ব্যবহার করা হত। এই সময় গম, জোয়ার, বাজরা, তুলা প্রভৃতি চাষ হত। চাষের কাজে ব্যবহৃত হত ষাঁড়।

(৫) পশুপালন: কৃষির ন্যায় পশপালনও বহু মানুষের জীবিকা ছিল। খাদ্যের প্রয়োজনে পালিত পশুর মধ্যে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস মুরগী ইত্যাদি ছিল। পরিবহনের জন্য পোষ মানানো হয়েছিল গাধা, উট, হাতি, বলদ ইত্যাদি পশুকে। শখ করে মানুষ বিড়াল, কুকুর ও বিভিন্ন পাখি পুষত।

(৬) শিল্পকর্ম জীবন ধারণের প্রয়োজনে বিভিন্ন শিল্পী ও কারিগর সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব হরপ্পা সমাজে ছিল। শিল্পকে কেন্দ্র করে বিশেষজ্ঞ শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল।

যেমন-মৃৎশিল্পী, চর্মকার, স্বর্ণকার, রাজমিস্ত্রী প্রভৃতি। ঝিনুকের মালা ও নৌকা নির্মাণ শিল্পী প্রমুখ অর্থনীতিতে নিজ নিজ প্রাধান্য স্থাপন করেছিল। টেরাকোটা শিল্পের আদলে বব নগ্ন নারীমূর্তি এই যুগের শিল্পীরা তৈরি করেছিল।

 মূল্যায়ন : সিন্ধুবাসীদের যে সাংস্কৃতিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে সিন্ধু সভ্যতাকে মিশর ও সুমেরীয় সভ্যতার চেয়ে উন্নত বলা যায়। তবে সিন্ধুসভ্যতা উদার ছিল না, রক্ষণশীল ছিল। তাই মেসোপটেমীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও সেখানকার সংস্কৃতি সিন্ধুবাসীদের প্রভাবিত করতে পারেনি।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা।

প্রাচীন বিশ্বে হরপ্পা সভ্যতার মতো এমন একটি উন্নত সভ্যতার স্রষ্টা কারা এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদগুলি নিম্নে আলোচিত হল-

(১) সুমেরীয় সৃষ্ট মতবাদ: স্যার মার্টিমার হুইলার ও অন্যান্য কয়েকজন পণ্ডিত মনে করেন যে প্রাচীন সুমেরীয়রা হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে সুমেরীয় সভ্যতার সাদৃশ্য লক্ষ করে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তবে মার্শাল, ব্যাসাম প্রমুখ ঐতিহাসিক হরপ্পা ও সুমেরীয় সভ্যতার মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখিয়ে উপরের মতটির তীব্র বিরোধিতা করেছেন।

(২) দ্রাবিড় সৃষ্টিতত্ত্ব: রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রেভারেন্ড হেরাল্ড, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ দেশী-বিদেশি পণ্ডিতদের মতে দ্রাবিড় জাতি হল হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। কারণ আর্য আগমনের পূর্বে দ্রাবিড়রা উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাস করত। ঋকবেদে যে অনার্যদের কথা বলা হয়েছে তা ছিল দ্রাবিড় গোষ্ঠী। হরপ্পা সভ্যতার মতোই শিব, শক্তি, লিঙ্গ ও যোনিপূজা দ্রাবিড়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল। সুতরাং দ্রাবিড়রাই হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। তবে কোনো কোনো পণ্ডিত দ্রাবিড় সৃষ্টিতত্ত্ব মেনে নিতে রাজি নন। তারা বলেছেন দ্রাবিড়রাই যদি হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা হয় তাহলে দ্রাবিড় সভ্যতার পাঠভূমি দাক্ষিণাত্যে হরপ্পা সভ্যতার অনুরূপ কোনো নাগরিক সভ্যতার বিকাশ ঘটল না কেন।

(৩) আর্য সৃষ্টি মতবাদ: এ.ডি.পুসলকার, এস.আর. রাও, অলচিন দম্পতি প্রমুখ দেশি বিদেশি ঐতিহাসিক মনে করেন যে আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা। তবে গর্ডন, চাইল্ড, জন মার্শাল, ব্যাসম প্রমুখ ঐতিহাসিকরা এই মতবাদটিকে অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে হরপ্পা ও আর্য সভ্যতার মধ্যে গুণগত পার্থক্য যথেষ্ট তাই আর্যরা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা হতে পারে না। 

(৪) মিশ্রজাতি মতবাদ: নৃতাত্তিকরা হরপ্পা সভ্যতায় পাওয়া কঙ্কালগুলির আছ খলি প্রভৃতি পরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছেন যে এখানে অন্তত চারটি জাতিগোষ্ঠাং মানুষ বসবাস করত। সেগুলি হল- (১) ককেশীয় (২) ভূমধ্যসাগরীয় (৩) আত্মীয় (৪) মোঙ্গলীয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন আদিম জনগোষ্ঠী হরপ্পা সভ্যতার কষ্ট।

মূল্যায়ন: সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলে হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা কারা সম্পর্কে হয়তো নিশ্চিতভাবে জানা যেত। কিন্তু সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার করা আজৎ সম্ভব হয়নি।

হরপ্পা সভ্যতার উৎস ও বিস্তার।

 ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুনদের পশ্চিমতীরে লারকানা জেলার মহেঞ্জোদড়োয় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল যে আর্য জাতির এদেশে আসার পর অর্থাৎ ১৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ভারতীয় সভ্যতার সূত্রপাত। কিন্তু ভারতীয় পুরাতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জোদড়োয় এবং দয়ারাম সাহানী হরপ্পায় মাটি খুঁড়ে মানুষের ব্যবহৃত এমন সব জিনিস আবিস্কার করেন যার ফলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব ও মৌলিকত্ব সম্বন্ধে ধারণা পাল্টে যায়। মানুষ জানতে পারে যে আর্যদের এদেশে আসার পর থেকে নয়, ভারতীয় সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল আরও অন্তত এক থেকে দেড় হাজার বছর আগে। অর্থাৎ অতি প্রাচীন এই ভারতীয় সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কাজেই ভারতীয় সভ্যতা যে পৃথিবীর প্রাচীনতম মেসোপটেমীয়, মিশরীয় ও চৈনিক সভ্যতাগুলিরই সমসাময়িক হরপ্পা সভ্যতার এই আবিষ্কারের ফলেই মানুষ তা জানতে পারে। ১

 উৎস ও বিস্তৃতি: ভারতে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে সিন্ধু নদের তীরে এক বিস্তীর্ণ সমভূমি নিয়ে এটি অবস্থিত ছিল। প্রায় ত্রিভুজাকৃতি এই নদী উপত্যকাটি মোটামুটি ১৩৫০ কিলোমিটার লম্বা ও ১০৫০ কিলোমিটার চওড়া। আজকে মরুভূমির বুকে হারিয়ে যাওয়া নদী সরস্বতী এর পূর্বপ্রান্ত ধরে বয়ে যেত। আর সিন্ধু ও তার উপনদ-নদীগুলি এর পশ্চিম প্রান্তকে সারা বছর শস্যশ্যামলা করে রাখত।

সিন্ধু সভ্যতা পৃথিবীর নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির মধ্যে প্রাচীনতম না হলেও ভারতবর্ষের মধ্যে যে প্রাচীনতম সভ্যতা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির মধ্যে সিন্ধু সভ্যতাই ছিল ব্যাপকতর এলাকায় বিস্তৃত। বালুচিস্তানের বোঢ় নদী থেকে একদিকে উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা-যমুনার দোয়াব ও অন্যদিকে গুজরাট পর্যন্ত এর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এই পর্যন্ত সিন্ধুসভ্যতার শতাধিক কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে নগর বলে যেগুলি চিহ্নিত হতে পারে সেগুলি হচ্ছে পাঞ্জাবের হরপ্পা, সিন্ধুপ্রদেশের মহেঞ্জোদড়ো ও চানহৃদড়ো, গুজরাটের ক্যামবে উপত্যকায় লোখাল, উত্তর রাজস্থানের কালিবানগান এবং হরিয়ানার হিসার জেলার বনওয়ালি। প্রধান দুটি নগর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর দূরত্ব প্রায় ৪৮৩ কিলোমিটার।