বিবর্তনের পথ ধরে জুরাসিক যুগ, তুষার যুগ প্রভৃতি অতিক্রম করে মানুষ এক সময় প্রস্তর যুগে এসে পৌঁছায়। আনুমানিক খ্রিসটপূর্ব ২,৬০,০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪,০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালকে প্রস্তরযুগ হিসাবে ধরা হয়। প্রস্তরযুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) প্রাচীন বা পুরাপ্রস্তর যুগ (খ) মধ্যপ্রস্তর যুগ (গ) নবপ্রস্তর যুগ।
প্রাচীন বা পুরা প্রস্তর যুগ: ল্যাটিন ভাষায় Palaeolithic এর ইংরেজি প্রতিশব্দ
Old Stone আর বাংলায় প্রাচীন বা পুরা প্রস্তর যুগ। এই যুগের বিস্তৃতি ছিল আনুমানিক ৫ লক্ষ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দ। ভারতের পাঞ্জাবের সোয়ান নদীর অববাহিকা, মাদ্রাজে প্রাচীন প্রস্তর যুগের বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন নেগ্রিটো জাতির মানুষরাই হল ভারতের প্রাচীনতম অধিবাসী।
প্রাচীন বা পুরা প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য: প্রাচীন বা পুরা প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি
নিম্নরূপ-
(১) পাথরের ব্যবহার: প্রাচীন প্রস্তরযুগে মানুষ সর্বপ্রথম পাথরের ব্যবহার শেখে। এই যুগে মানুষ একটি পাথরকে অন্য পাথর দিয়ে ঠুকে হাতিয়ার তৈরি করতে শেখে। পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল অমসৃণ ও বিরাট। এই যুগে অন্যতম হাতিয়ার ছিল পাথরের তৈরি হাতকুঠার। এছাড়া পাথর দিয়ে তারা বর্শা, ছুরি, অন্যান্য হাতিয়ার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করত।
(২) আশ্রয়স্থল: প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের কোনো নির্দিষ্ট আশ্রয়স্থল ছিল 'না। তাদের জীবনযাত্রা ছিল যাযাবরের মতন। খদ্যের ঘাটতি দেখা দিলে এক স্থান ত্যাগ করে তারা অন্যস্থানে চলে যেত। সাময়িকভাবে থাকবার জন্য তারা গুহা ব্যবহার করত। অনেক সময় তারা গাছের ওপরও আশ্রয় নিত। অনেক সময় আবার পাথর এবং গাছের ডালপাতা দিয়েও তারা আশ্রয় বানাত, যা দেখতে অনেকটা ঝুপড়ির মতো।
(৩) আগুনের ব্যবহার: প্রাচীন প্রস্তরযুগের প্রথম দিকে আদিম মানব আগুন সংগ্রহ করে রাখত। গাছে গাছে ঘর্ষণের ফলে বনে যে আগুন জ্বলে ওঠে তা তারা সংগ্রহ করে রাখত। পরে পাথরকে পাথরের সঙ্গে ঠুকে আগুন জ্বালাতে শিখেছিল।
(৪) খাদ্য: প্রাচীন প্রস্তর যুগে আদি মানব কৃষিকাজ জানত না। তারা ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। তাদের প্রধান খাদ্য ছিল মাংস। এছাড়া গাছের ফলমূলও তাদের খাবারের তালিকাভুক্ত ছিল। অর্থাৎ তারা নিরামিষ ও আমিষ দু'ধরনের খাবারই খেত।
(৫) শিকার: প্রাচীন প্রস্তর যুগে ঠাণ্ডা বাড়তে থাকায় জঙ্গলে আদি মানব কুড়োবার মতো কিছু আর পেল না। ইঁদুর, কাঠবেড়ালিও আর পাওয়া গেল না। যার ফলে আদি মানবদের পশু শিকারের দিকে নজর দিতে হয়েছিল। তারা দলবদ্ধভাবে শিকারের কাজ করত।
(৬) পোশাক পরিধান: প্রাচীন প্রস্তর যুগের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল আদি মানবদের পোষাক পরিধান। সেই সময়কার আদিমানব পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরত। পাতলা হাড়ের তৈরি সূঁচ দিয়ে চামড়াকে সেলাই করে তারা পোশাক বানাত। পশুর নাড়ি ভুড়ি সুতো হিসাবে ব্যবহার করা হত।
(৭) সমাজবদ্ধ জীবন প্রাচীন প্রস্তর যুগে সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজে নারীদের ভূমিকা ও প্রাধান্য ছিল বেশি। সেই সময় মানুষ ছিল শত্রু পরিবেষ্টিত। তাই তারা সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতো। ফলে আদি সমাজ গড়ে উঠেছিল।
(৮) শিল্পকলা: প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষের শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের আঁকা গুহাচিত্র থেকে। গুহাচিত্রের মধ্যে আছে শিকার, নাচ ও গানের ছবি। তবে বেশিরভাগ ছবি শিকারের ছবি।
(৯) বাদ্যযন্ত্র: প্রাচীন প্রস্তর যুগে কী ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হত তার কিছু নমুনা মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। প্রধান বাদ্যযন্ত্র ছিল হাড়ের তৈরি পাইপ বা ভেঁপু। সেকালে ব্যবহৃত আরেকটি বাদ্যযন্ত্র ছিল বুলরোরার অর্থাৎ যে যন্ত্র থেকে বাঁড়ের মতো গর্জন বেরোয়। বলগা হরিনের শিং দিয়ে এই যন্ত্রটি তৈরি করা হত। শিং থেকে আরেকটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হত, তার নাম শিঙা।
(১০) সমাধি প্রথার সূচনা: প্রাচীন প্রস্তর যুগে মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হত। এই সময়কার কবরের নিদর্শনও আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্যেকটি সমাধিতে মৃতদেহের পাশে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র রাখা হত, যাতে মৃত ব্যক্তি কোনোকিছুরই অভাব বোধ না করে। • মূল্যায়ন: প্রাচীন প্রস্তর যুগের জীবনযাত্রা ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। প্রাচীন প্রস্তর যুগের অবসানের পর মধ্যপ্রস্তর যুগের সূচনা হয়।
মধ্যপ্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
বিবর্তনের পথ ধরে জুরাসিক যুগ, তুষার যুগ প্রভৃতি অতিক্রম করে মানুষ এক সময় প্রস্তর যুগে এসে পৌঁছায়। আনুমানিক খ্রিসটপূর্ব ২,৬০,০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪,০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালকে প্রস্তরযুগ হিসাবে ধরা হয়। প্রস্তরযুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) প্রাচীন বা পুরাপ্রস্তর যুগ (খ) মধ্যপ্রস্তর যুগ (গ) নবপ্রস্তর যুগ।
মধ্যপ্রস্তর যুগ: মধ্যপ্রস্তর যুগ হল প্রাচীন প্রস্তর যুগ এবং নব্যপ্রস্তর যুগের মধ্যবর্তীকাল। মধ্যপ্রস্তর যুগের বিস্তৃতি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
মধ্যপ্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য: মধ্যপ্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি
নিম্নরূপ-
(১) সমাজজীবন: মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ ছিল আধা যাযাবর, আধা স্থায়ী। এই যুগের মানুষ মূলত দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি শাখা নদী ও সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে এবং অন্য শাখাটি মূল ভূমিতেই বসবাস করত। মধ্যপ্রস্তর যুগে মানুষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করত। আন্ত ও আন্তঃদলীয় সম্পর্ক ভালো ছিল। ◆(২) খাদ্য: মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী। তখনো তারা খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি। তাদের প্রধান খাদ্য ছিল পশুপাখি ও মাছ। মাছকে শুঁটকি করে তারা সংরক্ষণ করত। মাছ ছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীকে খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
(৩) হাতিয়ার: মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ পূর্বের তুলনায় হাতিয়ারের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এ িসময়ে প্রধান অস্ত্র ছিল তীর ধনুক। এই সময় মৎস্য শিকারে বঁড়শি, হারপুন, নৌকা, জাল ব্যবহৃত হত। হস্তকুঠার ছাড়া অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রে কাঠের হাতল সংযুক্ত করেছিল। পশুর হাড়, শিং ইত্যাদি দিয়েও অস্ত্র তৈরি হত।
(৪) বসতি: মধ্যপ্রস্তর যুগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল বসতি। এই যুগে অনেকে গুহায় বসবাস করলেও এই যুগেই প্রথম কুটির নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। এলাহাবাদের কাছে বেলান উপত্যকায় মধ্যপ্রস্তর যুগের একটি কুটির আবিষ্কৃত হয়েছে। আশেপাশে আরো বারোটি কুটির খুঁজে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটির আকৃতি গোল এবং কয়েকটি আকৃতি ডিম্বাকৃতি। কিছু কুটিরের চারপাশে বড়ো বড়ো প্রস্তর খণ্ড দিয়ে ঘেরা। ◆(৫) পোষাক: মধ্যপ্রস্তর যুগে মানুষ পোশাক হিসাবে গাছের ছাল ও পশুর চামড়া ব্যবহার করত। এই সময় সম্ভবত পশুচর্ম সেলাই করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই সময় হাড় ও পাথরের অলংকার ব্যবহৃত হত।
(৬) গুহাচিত্র: মধ্যপ্রস্তর যুগে মানুষ গুহাচিত্র অঙ্কনে পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। তাদের অঙ্কিত ছবিগুলিতে জ্যামিতিক জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ কোনো ছবি ছিল ত্রিকোণাকার, কোনোটি চতুষ্কোণাকার আবার কোনোটি বৃত্তাকার। ছবিগুলির বিষয়বস্তু মূলত শিকারের দৃশ্য। ছবিগুলিতে বাদামী, হলদে, সবুজ ইত্যাদি রঙের ব্যবহারও লক্ষ্য করার মতন।
(৭) মৃৎপাত্র: গুজরাটের লখনাজ অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন মধ্যপ্রস্তর যুগের শেষের দিকে মানুষেরা মাটির বাসনপত্র হাতে তৈরি করতে শিখেছিল।
(৮) আগুনের ব্যবহার: মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষেরা আগুনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। এই সময় চুল্লি তৈরির কাজও শুরু হয়।
(৯) পশুপালন: মধ্যযুগের মানুষরা পশুপালন করত। এই সময় মানুষ ভেড়া ও ছাগলকে বশে আনতে শুরু করেছিল। গরুকেও পোষ মানাতে শুরু করেছিল।
(১০) ধর্ম: মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষ ধর্ম ও জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী ছিল। সর্বপ্রাণবাদ, মহাপ্রাণবাদ, বস্তুভক্তি ও পূর্বপুরুষ পূজা ছিল তাদের ধর্ম সংক্রান্ত মূল মতবাদ।
(১১) সমাধি প্রথা: মধ্যপ্রস্তর যুগে মানুষকে সমাধিস্থ করা হত। সমাধিতে অলংকার, পোষাক, খাদ্য প্রভৃতি থাকত। এর থেকে অনুমান করা হয় যে মৃত্যুর পরবর্তী কোনো জীবন সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস ছিল।
মূল্যায়ন: মধ্যপ্রস্তর যুগের মানবকুল পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষের চেয়ে সবদিক দিয়েই উন্নতি করেছিল। তবে মধ্যপ্রস্তর যুগে সংস্কৃতির অগ্রগতি সর্বত্র একই হারে হয়নি।
নব্য বা নতুন প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি আলোচনা করো।
বিবর্তনের পথ ধরে জুরাসিক যুগ, তুষার যুগ প্রভৃতি অতিক্রম করে মানুষ এক সময় প্রস্তর যুগে এসে পৌঁছায়। আনুমানিক খ্রিসটপূর্ব ২,৬০,০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪,০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালকে প্রস্তরযুগ হিসাবে ধরা হয়। প্রস্তরযুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (ক) প্রাচীন বা পুরাপ্রস্তর যুগ (খ) মধ্যপ্রস্তর যুগ (গ) নব্য বা নতুন প্রস্তর যুগ।
নব্যপ্রস্তর যুগ: ল্যাটিন শব্দ Neolithic ইংরেজিতে Newstone যার বাংল প্রতিশব্দ নব্যপ্রস্তর যুগ। নবপ্রস্তর যুগের স্থায়িত্ব খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ থেকে ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষের জীবনধারাতে সর্বাঙ্গীন পরিবর্তন ঘটেছিল।
নব্য বা নতুন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য: নব্য বা নতুন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি
নিম্নরূপ:
(১) কৃষির সূচনা: নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজের কৌশল আবিষ্কার করে। এই আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয় এবং মানুষের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। পাথরের ফলার সাহয্যে মাটি খুঁড়ে বীজ বুনে ধান, গম, যব, ডাল, তুলা প্রভৃতি চাষ হত।
(২) হাতিয়ারের উন্নতি: প্রাচীন বা মধ্যপ্রস্তর যুগের পাথরের হাতিয়ারগুলির তুলনায় নব্যপ্রস্তর যুগে পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত ও মসৃণ। অস্ত্রগুলিতে হাতল লাগানো থাকত। এই যুগে হাড়ের তৈরি অস্ত্র বা হাতিয়ারের ব্যবহারও বৃদ্ধি পায়। এই যুগের মানুষ কোদাল, কাটারি, বর্শা, কাস্তে, তির ধনুক এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় অস্ত্র বানাত।
(৩) পশুপালন: নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালন করত। শিকারী মানুষ লক্ষ করেছিল যে পশুদের মধ্যে অনেকগুলি দুধ দেয় এবং বাচ্চা প্রসব করে। ঐসব পশুকে হত্যা না করে লালন পালন করলে প্রয়োজনের সময় আবার রোজকার খাবারেরও সুবিধা হবে। যেমন-দুধ, মাংস। তাছাড়া কৃষিকাজ চলতে থাকায় অনেক তৃণভোজী জন্তু শস্যক্ষেত্রের আকর্ষণে লোকালয়ের কাছে চলে আসত। ঐসব পশুকে গৃহপালিত করা বেশ সহজ ছিল। কৃষিদ্রব্য পরিবহন, লাঙল টানার কাজে ব্যবহারের জন্যও পশুপালন প্রয়োজন ছিল। এই যুগে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল, কুকুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
(৪) চাকার আবিষ্কার নব্যপ্রস্তর যুগের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল চাকা। প্রথম দিকে মাটির বাসনপত্র নির্মাণ করার জন্য চাকাকে ব্যবহার করা হত। পরে চাকার বৃত্তাকার ধারণাকে মানুষ গাড়ি, রথ এবং সুতো কাটার যন্ত্রে ব্যবহার করে। এর ফলে পরিবহনের ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি হয়।
(৫) নৌকার ব্যবহার: নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ নৌকার ব্যবহার শিখেছিল। সেই যুগে কয়েকটি গাছকে এক সঙ্গে আঁটি বেঁধে ভেলার মতো নৌকা জল পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হত। আর গাছের গুঁড়ির মধ্যভাগে কুঁদে গর্ত করে নৌকা বা ডোঙা সমুদ্র উপকূলে যাতায়াত ও মাল পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হত।
(৬) বয়ন শিল্প: নব্যপ্রস্তর যুগে বয়ন শিল্পের সূচনা হয়েছিল। তুলা ও পশমের সাহায্যে বয়নশিল্পের কাজ হত। পশুর নাড়ি ভুঁড়িকে শুকিয়ে, কখনো বা লতানে গাছকে সুতো হিসাবে ব্যবহার করে তারা সেলাই বা বয়নের কাজ করত।
(৭) যাযাবর জীবন ত্যাগ: নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ যাযাবর জীবন ছেড়ে গৃহনির্মাণ করে এক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শেখে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ পাথরের গুহাতেও বসবাস করত। ফলে এই সময় থেকে সমাজে ছোটো ছোটো গ্রাম গড়ে উঠতে থাকে এবং কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সংস্কৃতির সূচনা হয়।
(৮) শিল্পকলা: নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ প্রতীকি চিহ্নযুক্ত ছবি আঁকত, যা আগেকার যুগের চিত্রাঙ্কন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অনেকের ধারণা ঐ প্রতীকি চিহ্নগুলি লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রাথমিক প্রচেষ্টা। মৃৎপাত্রের গায়ে ছবি অলংকৃত করা হত। এই সময় মানুষ মাতৃকাদেবীর মূর্তি গড়েছিল।
(৯) ধর্মবিশ্বাস: পুরা প্রস্তর যুগে মানুষের মধ্যে যে ধর্মীয় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল নব্যপ্রস্তর যুগে তা অনেকটা পরিপূর্ণ বিশ্বাসে পরিণত হয়। সেই সময়কার মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করতে পারেনি, যে কারণে ঐ শক্তিকে ভয় পেত। তাই তারা প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করত।
(১০) মৃতদেহ সমাধি: নব্যপ্রস্তর যুগে মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হত। দণ্ডায়মান কয়েকটি পাথর খণ্ডের উপর অপর একটি পাথর খণ্ড পেতে সমাধি তৈরি করা হত। এটি ডোলমেন নামে পরিচিত।
মূল্যায়ন: নব্যপ্রস্তর যুগ নানাদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যায়ে কৃষির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গম ও বার্লি জাতীয় শস্য উৎপাদন শুরু হয় এবং কৃষির উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামজীবনেরও সূত্রপাত ঘটে। পাথরের তৈরি উপকরণ ব্যবহার করে শস্য ফলানোর চেষ্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এর ফলে মানুষকে আর শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়নি।